বানারীপাড়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে দু’শ বছরের পুরাতন ধান-চালের ভাসমান হাট

প্রথম পাতা » বরিশাল » বানারীপাড়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে দু’শ বছরের পুরাতন ধান-চালের ভাসমান হাট
সোমবার ● ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯


ভাসমান হাট
জি.এম রিপন,বানারীপাড়া প্রতিনিধি ॥
শেরে বাংলার স্মৃতি বিজড়িত বরিশালের বানারীপাড়ায় পর্যাপ্ত সাহায্যের অভাবে ও কুটিয়ালদের নি¤œমানের চাল উৎপাদনের কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে দু’শ বছরেরও বেশি পুরাতন ঐতিহ্যবাহী ভাষমান ধান-চালের হাট। সন্ধ্যা নদীর বুক চিরে দুই তীরে বয়ে যাওয়া বানারীপাড়ার ঐতিহ্যবাহী ধান-চালের এ ভাষমান হাটটি দেশে-বিদেশে নাম ছড়ালেও পর্যাপ্ত সাহায্যের অভাবে সেটি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। এক্ষেত্রে ঐতিহ্যবাহী এ ভাষ মান ধান-চালের হাটটি সরকারী ও বেসরকারী ভাবে রক্ষণা-বেক্ষণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট দায়ীত্বশীল ব্যক্তিদের সদ্বইচ্ছার অভাবে এমনটা হয়েছে বলে এলাকার অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতামলে এ ভাষমান ধান-চালের হাটটি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বেসরকারী ভাবে এলাকার বিত্তবানদের দিয়ে অটো রাইস মিল করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও সেটি আর আলোর মূখ দেখেনি। এক্ষেত্রে ঐতিহ্যবাহী এ ভাষ মান ধান চালের হাটটি রক্ষা করতে হলে চাল তৈরীর ক্ষেত্রে এলাকার কুটিয়ালদের আধুনিক প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি তাদের সহ সকল ধান ব্যবসায়ীদের আর্থিক সহায়তা হিসেবে সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে সহজ সর্তে ও কম মুনাফায় ঋণ দেয়া একান্ত প্রয়োজন বলেও এলাকার সচেতন মহল মনে করছেন।

এসব বিষয়ে জানা গেছে, বানারীপাড়ার সন্ধ্যা নদীর দুই তীরে পৃথক ভাবে বসা দু’টি ঐতিহ্যবাহী ভাষমান ধান-চালের হাট। এ হাটের বিষয়ে স্থানীয় বয়োবৃদ্ধরা জনান, তাদের মতে দু’শ বছরেরও বেশি পুরাতন এ ভাষ মান ধান-চালের হাট। এ হাটে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যাপারীরা শত শত নৌকায় ও ট্রলারে করে হাজার হাজার মন ধান কিনে নিয়ে আসতেন। পরে তারা সন্ধ্যা নদীর দান্ডয়াট ভাষান মহল (ভাষমান) ধানের হাটে ওই ধান স্থানীয় আড়ৎদারদের মাধ্যমে নাম মাত্র টাকা কমিশন দিয়ে এলাকার ও পাশর্^বর্তী হাজার হাজার কুটিয়াল’র কাছে বিক্রি করতেন। ব্যাপারীরা ধান বিক্রির টাকা দিয়ে আড়ৎদারদের কমিশন দিয়ে ও বন্দর বাজার থেকে সংসারের যাবতীয় বজার-সদায় সহ পরিবারের প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড় কিনে নিতেন। একই সময় তারা বানারীপাড়া বন্দর বাজারের মিষ্টির দোকানে গিয়ে আড়ৎদারদের কাছ থেকেও মিষ্টি-পান আপ্যায়ন গ্রহণ করতেন। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার কুটিয়াল বানারীপাড়ার সন্ধ্যা নদীর ভাষমান হাট থেকে ধান কিনে বাড়িতে নিয়ে নৌকার মধ্যে পানি দিয়ে এক থেকে ২-৩ দিন পর্যন্ত ভিজিয়ে রাখতেন। পরে তারা ওই নৌকার ভেজা ধান তীরে উঠিয়ে চুলার (তাফাল) ওপর ডোঙ্গায় রেখে সিদ্ধ করে বাড়ির উঠোনে কিংবা চাতালে (মাঠে) সুকিয়ে রাইস মিলে নিয়ে ধান মারাই করে চাল বাড়িতে নিয়ে আসতেন। পরে সেই চাল তারা বানারীপাড়ার লঞ্চ ঘাট সংলগ্ন সন্ধ্যা নদীর ভাষ মান চালের হাটে নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার চাল ব্যবসায়ীদের কাছে বাজার দর অনুযায়ী (চাল) বিক্রি করতেন।

জানা গেছে, ২৫/৩০ বছর পূর্বেও এখানকার কুটিয়ালদের মারাই করা (মলংগার) বাঁশ ফুল বালাম ও মোটা চাল এবং বোর (ইরি) চাল কিনে নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যপারীরা নৌকা, ট্রলার ও লঞ্চ যোগে ভোলা, লাল মোহন, খুলনা, বাগেরহাট, মোরেলগঞ্জ, রামপাল, পিরোজপুর, বরগুনা, আমতলী, পাথরঘাটা, আসুগঞ্জ, আঙ্গারিয়া, চরমুগুরিয়া, কালকিনি, মাদারীপুর, চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জ, কাঠপট্টি, নারায়নগঞ্জ ও ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাজার জাত করতেন। বর্তমানে সেখানের বেশির ভাগ এলাকায় অটো রাইচ মিল হওয়ার কারণে এখন আর এখানকার পুরাতন পদ্ধতিতে উঠোনে ধান শুকানো (কম শুকানো) চাল চাল ওই সব (অটো রাইস মিল) এলাকার ক্রেতারা এখন আর কিনতে চাইছেন না। ফলে এখানকার ধান-চালের ব্যবসায়ীরা পর্যাপ্ত সাহায্য সহযোগীতা না পাওয়ার কারণে তারা সেই কাঙ্খিত অটো রাইস মিল দিয়ে চাল তৈরী করতে পাচ্ছেন না। একারণে ক্রেতারা এখানকার চাল আর আগের মত অন্য জেলা-উপজেলায় কিনে নিতে আসছেন না। ফলে বানারীপাড়ার ধান-চালের ভাষমান হাট দিন দিন ছোট হয়ে আসছে।

এ বিষয়ে বানারীপাড়ার উত্তরপার বাজারের চালের আড়ৎদার ব্যবসায়ী মো.মজিবুর রহমান বলেন, এখানকার কুটিয়ালরা কম শুকানো চাল বাজারে বিক্রি করতে আনেন। তাদের ওই চাল বস্তায় রাখলে অল্প দিনের মধ্যেই গরম হয়ে দলা বেধে যায়। সে কারণে ওই চাল বস্তায় করে বেশি দিন আর রাখা যায় না। ফলে ক্রেতারা বাধ্য হয়ে অটো মিলের বেশি শুকানো চাল কিনে নিচ্ছেন। এক্ষেত্রে অনেক সময় ক্রেতারা তাদের কাছ থেকে প্রতারিতও হচ্ছেন। এর কারণ হিসেবে মজিবুর রহমান বলেন, অনেক চাল ব্যবসায়ীরা অটো রাইস মিলে রোবো (ইরি) কিংবা মোটা চাল ছাটাই করে বালাম চালের মত চিকন করে মিনিকেট নাম দিয়ে চরা দামে বাজারজাত করছেন। এক্ষেত্রে কুটিয়ালের তৈরী করা চাল কম শুকানো হলেও রোবো (ইরি) কিংবা মোটা চাল চিকন করার মত সুযোগ নেই।

মজিবুর রহমান বলেন, কুটিয়ালাদের চাল যদি অটো রাইসমিলের মত একটু বেশি শুকানো হতো তা হলে এই বানারীপাড়ার সন্ধ্যা নদীর ভাষ মান ধান-চালের হাট, তার ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারত। এক্ষেত্রে তিনি এখানকার কুটিয়াল ব্যবসায়ীদের অধুনিক পদ্ধতিতে চাল তৈরী করার প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি তাদের সহ ধান ব্যবসায়ীদের পর্যাপ্ত সাহায্য সহযোগীতা করা দাবী করেন।

একই ভাবে সন্ধ্যা নদীর ভাষমান ধান-চালের হাট সম্পর্কে নলশ্রী গ্রামের প্রবীন কুটিয়াল মো. রুস্তম আলী বলেন, এখন দেশের বিভিন্ন এলাকায় অটো রাইসমিল হয়েছে। এ কারণে তাদের চাল এখন আর আগের মতো চলে না। তারা এ ধরণের দূরবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পাশাপাশি নতুন করে আধুনিক পদ্ধতিতে চাল উৎপাদন করতে চান।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ আব্দুল্লাহ সাদীদ বলেন, কুটিয়ালদের চাল যাতে করে সারা দেশে বাজার জাত করা যায়, সে ব্যাপারে তিনি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানান।

এসএমজিএমআর/কেএস

বাংলাদেশ সময়: ১৭:৪৫:০৬ ● ৬৪৬ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ