ইটের বিকল্পে আগ্রহ নেই, অনিয়ন্ত্রিত ভাটায় বিপর্যয়ে স্বাস্থ্য-পরিবেশ

প্রথম পাতা » জাতীয় » ইটের বিকল্পে আগ্রহ নেই, অনিয়ন্ত্রিত ভাটায় বিপর্যয়ে স্বাস্থ্য-পরিবেশ
সোমবার ● ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯


ইটের বিকল্পে আগ্রহ নেই, অনিয়ন্ত্রিত ভাটায় বিপর্যয়ে স্বাস্থ্য-পরিবেশ

ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥

সরকার স্থাপনা নির্মাণে ইটের বিকল্প হিসেবে কংক্রিট ব্লক বা ফাঁপা ইট ব্যবহারের কথা বললেও তা এখনও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। একারণে কমেনি প্রচলিত ইটের ব্যবহার। এজন্য জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য প্রত্যক্ষ হুমকিস্বরূপ ইটভাটাগুলো যেন কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
জানা গেছে, বিগত বছরের ১৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সরকারের যেকোনও নির্মাণকাজে বিকল্প ইট হিসেবে পরিবেশবান্ধব ফাঁপা ইট ব্যবহার করতে হবে বলে নির্দেশনা দেয়া হয়। এতে বলা হয়, গৃহনির্মাণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এইচবিআরআই) উদ্ভাবিত বিকল্প এই ইট পরিবেশ বান্ধব ও অর্থসাশ্রয়ী। তাই এ বিকল্প ইট সরকারি কাজে ব্যবহারের জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
জানা গেছে, সহজ প্রযুক্তি ও স্বল্প শ্রমে এটা তৈরি করা যায়। এই ইট শব্দ ও তাপ নিরোধক, পরিবেশবান্ধব, ভূমিকম্প সহনীয় ও ব্যয় সাশ্রয়ী। এটি পরিবেশবান্ধবও। এই ইট তুলনামুলক কম ওজনের হওয়ায় ভূমিকম্পেও ঝুঁকি কম। একটি ব্যয়সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও দুর্যোগ সহনীয় নির্মাণ সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সরকারি সব নির্মাণ প্রকল্পে বিকল্প নির্মাণ প্রযুক্তি ও উপকরণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়। বলা হয়, সরকারি উন্নয়ন কাজে কার্যকর হলে বেসরকারি নির্মাতারাও এসব উপকরণ ব্যবহারে এগিয়ে আসবে। এ লক্ষ্য নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে সরকারি উন্নয়ন কাজে বালু বা পাথরের গুঁড়া ও সিমেন্টমিশ্রণ করে বিকল্পভাবে তৈরি হয় এই ফাঁপা ইট ব্যবহারের নিদের্শনা দেয়া হয়। যার স্থায়িত্ব সনাতনী ইটের চেয়ে অনেক বেশি। তবে এ সিদ্ধান্তের অগ্রগতি দেখা যায়নি। সরকারি উন্নয়ন কাজে এখনও বিকল্প (ফাঁপা) ইট ব্যবহার হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, যারা বাস্তবায়ন করবে তারাই এ ব্যাপারে কার্যকরী উদ্যোগ নিচ্ছে না, ফলে এখনও বিকল্প ইট ব্যবহার শুরু হয়নি।
বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, সড়ক ও ঘরবাড়ি নির্মাণে তাই বিপুল পরিমাণে ব্যবহৃত হচ্ছে মাটি পুড়িয়ে বানানো সনাতন ইট। আর বন উজাড়, কৃষির ক্ষতি ও দেশের ভূ-প্রকৃতি ধ্বংস করে মাটি পুড়িয়ে তৈরি করা হচ্ছে এসব ইট। ফলে ইটভাটা সংশ্লিষ্ট এলাকার পাশাপাশি সারা দেশেই পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইটভাটার কারণে পরিবেশ দূষণ, ভূমির উর্বরতা হ্রাস ও বন উজাড় হচ্ছে। কৃষি জমি দিন দিন কমছে। ইটভাটাতে মাটির জোগান দিতে ফসলের জমি অকেজো গর্তে পরিণত হচ্ছে। কেবল সমতল ভূমি নয়, কোথাও কোথাও পাহাড় পর্যন্ত কাটা হয় ইটভাটার মাটি জোগাড় করার জন্য।
এদিকে, রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন রাস্তার দু’পাশে যতদূর চোখ যায় শুধু ইটের ভাটা। এসব ইট ভাটায় কয়লার পাশাপাশি কাঠও পোড়ানো হয়। অথচ কাঠ পোড়ানো নিষিদ্ধ। ফসলি জমিতে লোকালয়ে এসব ইটভাটার চিমনির উচ্চতা কোনোটিরই ৬০ ফুটের বেশি নয়। অথচ চিমনি থাকতে হবে ১২০ ফুট লম্বা। ইটের ভাটার চিমনি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ায় এসব এলাকার বাসিন্দারা অতিষ্ঠ। এমনকি আশপাশের গাছ মরে যাচ্ছে। গাছের পাতা শুকিয়ে ঝরে পড়ছে। এছাড়া দেশের ইটভাটাগুলোতে বছরে প্রায় ৫৭ লাখ টন কয়লা এবং কোনো কোনো ভাটায় গোপনে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। ফলে পরিবেশ ও বায়ুদূষণ হচ্ছে।
এদিকে, ঢাকায় ইটভাটার জন্য ৫৮ শতাংশ পরিবেশ দূষণ হয় বলে জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ুমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। তিনি বলেন, বায়ু দূষণ রোধে আমরা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। ঢাকাসহ বড় বড় জেলা শহরে বায়ুর মান নিরুপণের জন্য ১৬টি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বায়ুর মান নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। তিনি বলেন, আমাদের ৫৮ ভাগ বায়ু দূষণ হয় ঢাকা সিটির ইট ভাটার জন্য। ইট ভাটা বন্ধের জন্য পরিকল্পনা ও আইন পাস করা হয়েছে। ৬৫ ভাগ ইটখোলা যাতে বায়ু দূষণ না হয়, সেই পরিকল্পনার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। আমরা শতভাগ বাস্তবায়ন করতে পারব বলে আশা করছি।
সূত্রমতে, আগামি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে ইট সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে ব্লক ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সরকারি নির্মাণ, মেরামত ও সংস্কার কাজে ইটের ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করার জন্য চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০) টেন্ডার ডকুমেন্টসে ব্লক ব্যবহারের হার ১০ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২০ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩০ শতাংশ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬০ শতাংশ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৪ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শতভাগ নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে ইটের ব্যবহার বন্ধ করে ব্লকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিষয়ে সুপারিশ দিতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট, স্থাপত্য অধিদফতরের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কারিগরি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, নির্মাণ কাজে ব্লকের ব্যবহার যত বাড়বে এর উৎপাদনও তত বাড়বে। এর ফলে মাটি পুড়িয়ে ইট বানানো ভাটাগুলোরও দৌরাত্মও সে অনুযায়ী কমে যাবে।

এফএন/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ১৯:৩৮:৪৫ ● ৪৩৪ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ