ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) সাগরকন্যা প্রতিনিধি॥
২০০৬ সালের এই দিনে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার কয়লা খনি প্রকল্প বাতিল ও বিদেশি এশিয়া এনার্জি কোম্পানিকে দেশ ত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ ও বিডিআর বাহিনি। সেইদিন সেই সময় শতাধিক লোক আহতসহ ঘটনা স্থলে তিন জনের র্মমান্তিক মৃত্যু ঘটে।
দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলায় বিক্ষোভ, র্যালী ও সমাবেশসহ নানা আয়োজনে ২৬আগস্ট পালিত হয় ১৩তম ফুলবাড়ী ট্রাজেডি দিবস। দিনটি উদ্যাপন উপলক্ষে ফুলবাড়ী উপজেলায় সকাল থেকেই ছোট-বড় সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে কালো ব্যাচ ধারন, শোক র্যালী, শহীদ স্মৃতি সৌধে পুষ্পার্ঘ অর্পনের মধ্য দিয়ে পালিত হয়েছে ফুলবাড়ী ট্রাজেডির দিবস।
দিনের শুরুতে সকাল সাড়ে ৯টায় ফুলবাড়ী বাজার থেকে সম্মিলিত পেশাজীবী সংগঠনের ব্যানারে শোকর্যালী বের করে ফুলবাড়ীবাসী। র্যালীটি শহরের ঢাকা মোড় হয়ে প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে ২০০৬ সালের নিহতদের শহীদ স্মৃতিস্তমে গিয়ে শেষ হয়। পরে সেখানে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শহীদ বেদীতে পুস্পমাল্য অর্পন ও শপথবাক্য পাঠ করানো হয়। শপথবাক্য পাঠে নেতৃত্বদেন ফুলবাড়ী আন্দোলনের নেতা ও ফুলবাড়ী পৌরসভার মেয়র মুরতুজা সরকার মানিক।
এদিকে সকাল ১১ টায় নিমতলা মোড় থেকে একটি শোকর্যালী বের করে তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতাকর্মীরা। পরে শহীদ বেদীতে পুস্পমাল্য অর্পন করে নিমতলা মোড়ে একটি প্রতিবাদী জনসভা করেন। র্যালী ও সমাবেশে তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, গনসংহতি প্রধান সমন্বয়কারী জুনাইদ সাকিসহ কেন্দ্রীয় অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ও স্থানীয় নেতাকর্মীরা অংশগ্রহন করেন। ফুলবাড়ী ট্রাজেডি দিবসের নানা কর্মসূচীর মধ্যে একান্ত সাক্ষাৎকারে তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ কথা বলেন। তিনি বলেন, এশিয়া এনার্জিকে বহিস্কারসহ বিচারের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি ফুলবাড়ীর নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। এসব দাবী মানা না হলে অক্টোবর ও নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বিক্ষোভ মিছিল, দিনাজপুর মূখি পদযাত্রাসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এর মধ্যেও যদি অপতৎপরতা না থামে আরো বৃহত্তর কর্মসূচী দেয়া হবে।
উল্লেখ্য যে, ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট বিকেল ৩টায় উপজেলার ঢাকা মোড়ে বিশাল প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। শোভার প্রতিপাদ্য এশিয়া এনার্জিকে তাদের সবকিছু গুটিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে, নইলে তাদের কার্যক্রম চিরতরে অবরুদ্ধ করার ঘোষনা দেয়া হয়। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির পূর্ব ঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ কর্মসূচি পালিত হয়।
সে সময় ফুলবাড়ীসহ পাঁচ উপজেলার সাধারণ জনতা বিশাল বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে ফুলবাড়ীতে অবস্থিত এশিয়া এনার্জি কোম্পানির অফিসের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে ছোট যমুনা ব্রিজের উপর বিডিআর ও পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ ও টিয়ার শেল নিক্ষেপসহ জনতার ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফুলবাড়ীর চাঁদপাড়া গ্রামের তরিকুল ইসলাম (২২), বারকোনা গ্রামের শিশু আমিন (১০) ও নবাবগঞ্জ উপজেলার ঝড়ারপাড় গ্রামের সালেকিনের (১৫) মৃত্যু হয়।
এ ঘটনার পরের দিন ফুলবাড়ীসহ পাশ্ববর্তী উপজেলার সর্বস্তরের জনতা প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে। আন্দোলনকারীরা গাছের গুঁড়ি দিয়ে প্রধান সড়ক সহ ,রেলপথ ও রাজপথ বন্ধ করে দেয়। উত্তরের জনপদে সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সকালে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে জনতার ঢলে কম্পিত হয়ে ওঠে ফুলবাড়ী শহর বন্দর এবং শহরের প্রতিটি দোকানপাট, ব্যাংক-বীমা, অফিস আদালতের কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়। ২৮ আগস্ট গণ¯্রােতের মুখে ১৪৪ ধারা সহ বিডিআর,পুলিশ প্রত্যাহার করে নিতে সরকার বাধ্য হয়।
তৎকালিন প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধিরা ৩০ আগস্ট জাতীয় কমিটির সিদ্ধান্ত মতে পার্বতীপুর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে ফুলবাড়ী আন্দোলনের নেতা-নেত্রীর সঙ্গে তাঁদের তিন ঘণ্টাব্যাপী রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ব্যাপক আলোচনা শেষে এশিয়া এনার্জিকে প্রত্যাহার, হতাহতদের ক্ষতিপুরণসহ ছয় দফা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তা অদ্রবদি ছয় দফা চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় সেই থেকে ২৬ আগস্ট দিনটিকে ফুলবাড়ী ট্রাজেডি হিসেবে পালন করা হচ্ছে।
বরাবরের ন্যায় তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি এ দিনটিকে ‘জাতীয় সম্পদ রক্ষা দিবস’ এবং সম্মিলিত পেশাজীবী সংগঠন ও ফুলবাড়ীবাসীর পক্ষ থেকে ‘ফুলবাড়ী শোক দিবসটি” যথাযথ মর্যদায় উদযাপান করছেন।
এএইচসি/এমআর