মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া সাগরকন্যা অফিস॥
১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত দৌলতপুর সালেহিয়া ইসলামিয়া আলিম মাদরাসা। বর্তমানে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪৬৫, এর মধ্যে ছাত্রী রয়েছে ২৬২। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এ মাদরাসা ক্যাম্পাসে সহশিক্ষা তো দুরের কথা, ছাত্রীদের ক্যাম্পাসে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। কাগজপত্রে ছাত্রী ছিল। কিন্তু তাদের কাপড় টানিয়ে আশ-পাশের বাড়িতে গিয়ে পাঠদান করতেন শিক্ষকরা। তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার গোলাম রব্বানীর নির্দেশে ছাত্রীদের মাদরাসা ক্যাম্পাসে ক্লাশের ব্যবস্থা হয়। শুরু হয় সহশিক্ষা কার্যক্রম। কিন্তু এ মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ৭৯ বছরেও একজন মহিলা শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়নি। বর্তমানে ১৪ জন শিক্ষক আর তিনজন কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন। সবাই পুরুষ। নারী শিক্ষার অগ্রগতি হলেও ছাত্রীদের প্রাঞ্জল শিক্ষার জন্য একজন নারী শিক্ষক নেই। ছাত্রীদের একান্ত কিছু সমস্যা ছাড়াও তাদের স্বাচ্ছন্দে কথা বলতে নারী শিক্ষকের প্রয়োজন অত্যাবশ্যক। তা করা হয়নি। পুরুষ কেন্দ্রীক ধ্যান-ধারনার কারনে সরকার নারী শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করলেও এখানকার মাদরাসা শিক্ষার প্রধান কিংবা ব্যবস্থাপনা কমিটির আন্তরিকতার ঘাটতির কারণেই এ প্রতিষ্ঠানে ৭৯ বছরেও নারী শিক্ষক পদায়ন হয়নি। টিনশেড জীর্ণদশার দোচালা মাটির ফ্লোরে ক্লাশ চলত। এখন বহুতল ভবন হয়েছে। রাস্তা পাকাকরন হয়েছে। কিন্তু নারীদের অগ্রগতির জন্য নারী শিক্ষক পদায়ন হয়নি। এনটিআরসি সম্প্রতি একজন নারী শিক্ষক নিয়োগ দেয়। সেও অন্যত্র চলে গেছেন।
১৯৪৩ সালে প্রতিষ্ঠিত কলাপাড়া পৌরশহরের খেপুপাড়া নেছারুদ্দিন ফাজিল মাদরাসা। বর্তমানে ৬২৬ জন শিক্ষার্থী। ২৬০ ছাত্রী রয়েছে। ৩২ জন শিক্ষক রয়েছে এ মাদরাসায়। এর মধ্যে প্রভাষক পদে তিন জন এবং সহকারী শিক্ষক পদে তিন জন নারী শিক্ষক রয়েছেন। এ প্রতিষ্ঠানে প্রথম প্রভাষক পদে মোসাম্মৎ মাসুমা আক্তার যোগদান করেন ২০১১ সালে। বর্তমানে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষসহ তিনটি পদ শুন্য রয়েছে। মোস্তফাপুর সামসুন্নাহার বালিকা দাখিল মাদরাসা প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৮৪ সালে। শুধু নারী শিক্ষার এ মাদরাসা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী রয়েছে ২৬৪ জন। শিক্ষক রয়েছেন ১২ জন। এর মধ্যে দুই জন নারী শিক্ষক আছেন। তাও ২০১৬ সালে বাংলার শিক্ষক খায়রুন্নেছা সুখীকে এবং সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক আশরুফা বেগমকে নিয়োগ দেয়া হয় ২০১৪ সালে। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর মধ্যে একজন আয়া রয়েছে নারী। নারী শিক্ষার উন্নয়নে করা এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন তারা মানসিকভাবে আরও প্রাঞ্জল থাকত, যদি নারী শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ত। এখন সাবলীলভাবে ক্লাশ সময় পার করতে পারছে না। ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বাদুরতলী বালিকা দাখিল মাদ্রাসায় ছাত্রী সংখ্যা ৬৫ জন। এখানে পাঁচজন শিক্ষক রয়েছেন। এরমধ্যে নারী শিক্ষক আশরাফুন্নেছা নিয়োগ পান ২০০৪ সালে। ধানখালী মহিলা দাখিল মাদরাসায় ৩১৬ ছাত্রী রয়েছে। এখানে ১৪ শিক্ষকের মধ্যে কর্মচারী মিলে তিন জন নারী শিক্ষক রয়েছেন। তাও একজনকে ২০০৪ সালে, অপরজনকে ২০১৫ সালে নিয়োগ দেয়া হয়। যেন সর্বত্র নারী শিক্ষক নিয়োগে এক ধরনের চরম অনীহার চিত্র দৃশ্যমান।
মুসল্লীয়াবাদ ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৬৯ সালের পহেলা জানুয়ারি। বর্তমানে ৬৭৯ শিক্ষার্থী রয়েছে। এর মধ্যে ছাত্রী রয়েছে ৩৪৮ জন। ২০ জন শিক্ষক ও দুই জন কর্মচারী রয়েছে মাদরাসায়। ২০১৮ সালে এখানে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে নিয়োগ দেয়া হয় সহকারী শিক্ষক কামরুন্নাহারকে। এছাড়া ইবতেদায়ী জুনিয়র শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় সিরাজাম মনিরাকে। এ দুইজন মহিলা শিক্ষক মাদরাসায় পদায়ন হয় মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পরে। মোয়াজ্জেমপুর ছালেহিয়া আলিম মাদ্রসা প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৪০ সালে। প্রতিষ্ঠার ৭৮ বছর পরে এনটিআরসি সহকারী মৌলভী পদে একজন মহিলা শিক্ষক নিয়োগ দেয় ২০১৭ সালে। বর্তমানে সেও নেই। অন্য মাদরাসায় চলে গেছেন। এ মাদ্রাসায় ৫৫০ জন শিক্ষার্থীর অর্ধেকেরও বেশি ছাত্রী রয়েছে। অধ্যক্ষ মাওলানা মোঃ আবুবকর জানান, বর্তমানে তারা ২০ জন শিক্ষক রয়েছেন। তবে দুইটি শুন্যপদে শিক্ষক চেয়ে চিঠি দিয়েছেন উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে। বর্তমানে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোন নারী শিক্ষক নেই। পূর্বমধুখালী সালেহিয়া দাখিল মাদ্রসা প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৮৪ সালে। এ মাদরাসায় মোট শিক্ষার্থী ৩২৬ জন। এখানে নারী শিক্ষার্থী রয়েছে ১৬০ জন। কিন্তু কোন নারী শিক্ষক আজ অবধি পদায়ন হয়নি। শিক্ষক কর্মচারী মিলে পদায়ন রয়েছে ১৮ জন।
রজপাড়া দ্বীন-ই-এলাহি দাখিল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৭৫ সালের পহেলা জানুয়ারি। এখানে শিক্ষার্থী রয়েছে ৩৬৯ জন। ছাত্রী রয়েছে ১৯০ জন। মোট শিক্ষক রয়েছেন ১৩ জন। এখানে নারী শিক্ষক রয়েছেন তিনজন। প্রথম এখানে বাংলার শিক্ষক মোসাম্মৎ রাবেয়া বেগম যোগদান করেন ১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাসে। রাবেয়া বলেন, নারী শিক্ষার উন্নয়নে নারী শিক্ষক পদায়ন থাকা খুবই জরুরি প্রয়োজন। মেয়েরা অনেক ব্যক্তিগত সমস্যা নারী শিক্ষক ছাড়া বলতে পারে না। আর মেয়েদের মায়ের ¯েœহ দিয়ে শিক্ষা দিতে পারেন নারী শিক্ষক, এমন মন্তব্য এ শিক্ষকের। কলাপাড়া মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের দেয়া তথ্যমতে উপজেলায় মোট ২৭টি মাদরাসা রয়েছে। এসব মাদ্রাসায় নয় হাজার নয় শ’ ৯৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। যার মধ্যে নারী শিক্ষার্থী শতকরা ৫৫ ভাগ। প্রায় পাঁচ হাজার পাঁচ শ’ জন। শিক্ষক রয়েছে মোট ৩৬৩ জন। এর মধ্যে নারী শিক্ষক রয়েছে মাত্র ৩৪ জন। এসব মাদরাসায় নারী শিক্ষক নিয়োগে এক ধরনের অনীহা লক্ষ্য করা গেছে। অথচ নিয়ম রয়েছে শতকরা ৩০ ভাগ নারী শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার।
২০১১ সাল থেকে অধিকাংশ মাদরাসায় দুই একজন নারী শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম শুরু হয়। বহু ছাত্রীরা নারী শিক্ষক না থাকায় তাদের ব্যক্তিগত সমস্যাসহ সাবলিলভাবে শিক্ষায় অংশ নিতে পারছে না। এক কথায় নারী শিক্ষার যে হারে প্রসার ঘটছে তা ধরে রাখতে নারী শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার কোন বিকল্প নেই। দ্বিতীয় বর্ষের মাদ্ররাসা শিক্ষার্থী মোসাম্মৎ বুশরা বলেন, ‘নারী শিক্ষক থাকা একান্ত প্রয়োজন। ব্যক্তিগত সমস্যা বলতে আমরা মায়েদের মতো সহায়তা পাই নারী শিক্ষকদের কাছ থেকে, এর কোন বিকল্প নেই।’
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক মোসাম্মৎ মাসুমা বেগম সুনির্দিষ্ট উদাহরন টেনে বলেন, অষ্ঠম শ্রেণির এক ছাত্রী ক্লাশ চলাকালে শারীরিক সমস্যার কারণে ছুটি চাইতে গিয়ে তার কাছে বলতেই দ্বিধায় ভোগছিল। এর থেকে প্রমানিত, নারী শিক্ষার্থীর জন্য নারী শিক্ষক অত্যাবশ্যক। কলাপাড়া ইমাম সমিতির নেতা প্রভাষক মাওলানা মোঃ মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘ নারী শিক্ষার বিকল্প নেই। আর বর্তমান সরকারের নারী শিক্ষার উন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। নারী শিক্ষার এমন প্রসার ধরে রাখতে অবশ্যই প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত নারী শিক্ষক নিয়োগ দেয়া জরুরি প্রয়োজন।’ কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মুনিবুর রহমান জানান, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।
এমইউএম/এমআর