রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন যেকোনো সময় শুরু হবে: পররাষ্ট্র সচিব

প্রথম পাতা » জাতীয় » রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন যেকোনো সময় শুরু হবে: পররাষ্ট্র সচিব
রবিবার ● ১৮ আগস্ট ২০১৯


রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন যেকোনো সময় শুরু হবে: পররাষ্ট্র সচিব

ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥

আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন এ মাসেই শুরুর খবর এলেও পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ জানাতে রাজি হননি।
রাজধানীতে রবিবার (১৮ আগস্ট) এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, বিষয়টি (প্রত্যাবাসন) এখনও আলোচনার টেবিলে রয়েছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, যেকোনো সময় শুরু হবে। রোহিঙ্গাদের তাদের দেশ মিয়ানমারে ফেরানো কবে শুরু হবে, সাংবাদিকরা আবারও জানতে চাইলে তিনি কোনো সুনির্দিষ্ট সময় বলতে রাজি হননি।
দুই বছর আগে মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমন অভিযান শুরুর পর সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে ছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা। এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীদের নিজ দেশে ফেরাতে দুই দেশের মধ্যে চুক্তিও হয়েছে, যার আলোকে গত বছর নভেম্বরে প্রত্যাবাসন শুরুর প্রস্তুতিও নিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে রোহিঙ্গাদের মনে আস্থা না ফেরায় এবং তারা কেউ ফিরে যেতে রাজি না হওয়ায় সেই পরিকল্পনা ঝুলে যায়।
সম্প্রতি মিয়ানমারের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বিদেশী একটি সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে, আগামি ২২ অগাস্ট প্রায় সাড়ে তিন হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার দিন ঠিক হয়েছে। জুলাই মাসে দুই দেশের প্রতিনিধি দলের বৈঠকে প্রত্যাবাসন চুক্তির অংশ হিসেবে যাচাই বাছাইয়ের জন্য মিয়ানমারের হাতে যে ২৫ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা বাংলাদেশ দিয়েছিল সেখান থেকেই ৩ হাজার ৫৪০ জনকে নেওয়ার বিষয়ে ছাড়পত্র মেলার কথা জানিয়েছিলেন মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মিন্ট থু।
পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, আগামী কয়েক সপ্তাহে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরানোর জন্য আমরা তাদেরকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করব। তাদের কল্যাণেই এটা করা হবে। যদি তারা ফিরে না যায়, তাহলে তারা শুধু ভূমির অধিকারই নয়, সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আমরা মনে করি রোহিঙ্গারা সম্মানের সঙ্গে নিজদেশে ফিরে যাবে। এজন্য সরকারিভাবে আলোচনা অব্যাহত আছে, আশা করা যায় আগামি দুই সপ্তাহের মধ্যে এর অগ্রগতি আসবে।
মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, আমরা রোহিঙ্গাদের রিফিউজি হিসেবে আশ্রয় দেইনি, মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশ জনবহুল হওয়ায় এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে স্থানীয়ভাবে পুনর্বাসন সম্ভব না। আমরা মনে করেছিলাম প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্রগুলো এ সংকটে এগিয়ে আসবে, কিন্তু তা হয়নি। একটি দেশে গণহত্যা হচ্ছে অথচ বিশ্ব নীরব, তাদের নিজদেশে ফেরানোর কোনো উদ্যোগ নেই। কোথায় বিশ্ব, কোথায় বিশ্ব আইন-মানবাধিকার।
বিসের গভর্নিং বডির সাবেক চেয়ারম্যান মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেন, রোহিঙ্গা সংকট তৈরি করেছে মিয়ানমার। তাদের এর সমাধান দিতে হবে। আমরা আশা করছি অন্তত ছোট আকারে হলেও রোহিঙ্গাদের নিজদেশে ফেরাটা শুরু হোক, পরে না হলে ডিমান্ড নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে তাদের নিজদেশে ফেরাটা যেন সম্মানের হয়, নিরাপত্তার হয় সেটাও দেখতে হবে। গ্রিন অ্যান্ড রেড রিসার্চের পরিচালক শহিদুল ইসলাম চৌধুরীর পরিচালনায় আয়োজিত সেমিনারে বিভিন্ন এনজিও এবং দূতাবাসের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চলছে প্রস্তুতি: রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে মিয়ানমারের একটি দল ঢাকায় এসেছে। আর ২২ আগস্ট আন্তর্জাতিক একটি সংবাদ সংস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হতে পারে বলে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ায় আবারও নড়াচড়া শুরু হয়েছে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে।
সরেজমিন দেখা গেছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য গত বছর তৈরি করা টেকনাফের নাফ নদের সীমান্তে অবস্থিত কেরণতলী ঘাটটিতে আবারও সংস্কারের কাজ চলছে। এখানকার বাতাসে ফিসফাস, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হতে পারে সহসাই। তবে রোহিঙ্গারা এখনও জানেন না, কীভাবে কোন কোন শর্তে তাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নিতে চায় মিয়ানমার। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে সরকারের আনুষ্ঠানিক কোনও বক্তব্য বা পদক্ষেপের বিষয়ে এখনও কোনও তথ্য জানা যায়নি। বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন (আরআরআরসি)। এই কমিশনের কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর ব্যাপারে বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে কখন প্রত্যাবাসন শুরু হবে সে বিষয়ে এখনও অবগত নই।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর) আরআরআরসি-এর পাশাপাশি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি দেখভাল করছে। এজন্য দেশে ফিরতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিবেদন তৈরি করে সরকারের কাছে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে তাদের। তবে বিষয়টি নিয়ে সংস্থাটির কোনও কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি। এদিকে, গত শনিবার টেকনাফ কেরণতলী প্রত্যাবাসন ঘাট পরিদর্শনে গিয়ে সেখানে কয়েকজন শ্রমিককে কাজ করতে দেখা গেছে। এ সময় প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করা একটি দলকেও প্রত্যাবাসন কেন্দ্রের বিভিন্ন স্থান ও কক্ষ ঘুরে দেখতে দেখা যায়। তবে গণমাধ্যমকে এড়িয়ে যান তারা। তবে প্রত্যাবাসন ঘাটে দায়িত্বে থাকা প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের প্রতিনিধি মোহাম্মদ শহীদুল হাসান জানান, এই ঘাট দিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হওয়ার কথা রয়েছে। তাই কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এখানে কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন কাজকর্ম চলছে। প্রত্যাবাসন ঘাটে দায়িত্বরত ১৬ আনসার ব্যাটালিয়নের হাবিলদার মোহাম্মদ আইনুল হক বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ঘাটে কয়েকদিন ধরে কাজ চলছে। তাদের আমরা সহযোগিতা করছি। শুনেছি, কয়েকদিনের মধ্যে এই ঘাট দিয়ে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফেরত যাবে। এরপর পাশের নয়াপাড়া শালবন রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করে দেখা গেছে, প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা চলছে। এ ছাড়া, এই রোহিঙ্গা শিবিরের সিআইসি কার্যালয়ের পাশে ‘প্রত্যাবাসনের তালিকায়’ নাম থাকা রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য তড়িঘড়িভাবে প্লাস্টিকের ছোট ছোট ঘর তৈরি করে ঘেরা দিতে দেখা গেছে। এখানেও বেশকিছু রোহিঙ্গা শ্রমিক কাজ করছিলেন। এর মধ্যে কথা হয় আবদুল করিম নামে এক শ্রমিকের সঙ্গে। তিনি বলেন, মিয়ানমারে ফেরত যাবে এমন রোহিঙ্গাদের জন্য এসব তৈরি করা হচ্ছে। আমরা শুনেছি, কিছু রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কথা রয়েছে। এই শিবিরের চেয়ারম্যান রমিদা বেগম বলেন, শুনেছি, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হবে। তবে হঠাৎ করে কারও সঙ্গে কথা বললে এই প্রত্যাবাসন নিয়ে রোহিঙ্গাদের মাঝে হতাশা বিরাজ করে। কেননা, শিবিরের সিআইসি কার্যালয়ে পাশে এনজিওরা তাড়াহুড়াভাবে ছোট ছোট ঘর তৈরি করছে। এ নিয়ে রোহিঙ্গাদের মাঝে কানাঘুষা চলছে। টেকনাফের জাদিমুড়া ২৭ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হোক, সেটি আমরা চাই। তবে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিচার নিশ্চিত করে নিজ দেশের নাগরিকত্ব দিলে আমরা ফেরত যেতে প্রস্তুত। হঠাৎ করে প্রত্যাবাসনের খবরে রোহিঙ্গারা উদ্বিগ্ন। কীভাবে কী হচ্ছে তা আমরা বুঝতে পারছি না।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে ২৫ আগস্টে কোরবানি ঈদের মাত্র কয়েকদিন আগে রাখাইনের ৩০টি নিরাপত্তা চৌকিতে একযোগে হামলার ঘটনা ঘটে। প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নিপীড়ন শুরু করে। ফলে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। পুরনোসহ উখিয়া-টেকনাফের ৩০টি শিবিরে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। তবে জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ৮৫ হাজার ৫৫৭। এর মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি। জাতিগত নিধন ও গণহত্যার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পন্ন হয়। এ চুক্তি অনুযায়ী ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমার তারিখ নির্ধারণ করলেও শেষ সময়ে এসে বেঁকে বসে রোহিঙ্গারা। নিরাপত্তাহীনতার উদ্বেগ, সংঘটিত হত্যাকা-সহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের কোনও প্রতিশ্রুতি না থাকা, নিজ গ্রামে ফিরে যেতে না দিয়ে বদ্ধ শিবিরে আটকে রাখার আশঙ্কা, নাগরিকত্ব না দেওয়া ইত্যাদি কারণে মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাননি উদ্বাস্তু রোহিঙ্গারা। এ কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াও শুরু করা যায়নি। তবে সেসময়েই উখিয়ার ঘুমধুমের প্রত্যাবাসন ঘাটের পাশাপাশি টেকনাফের নাফ নদের তীরের এই কেরণতলী (নয়াপাড়া) প্রত্যাবাসন ঘাটটি নির্মাণ হয়েছিল। এর মধ্যে টেকনাফের প্রত্যাবাসন ঘাটে প্যারাবনের ভেতর দিয়ে লম্বা কাঠের জেটি, ৩৩টি সেমি-টিনের থাকার ঘর, চারটি শৌচাগার রয়েছে। সেখানে ১৬ আনসার ব্যাটালিয়ন ক্যাম্পের সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছেন।

এফএন/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ২০:২৩:২৯ ● ৩৯৫ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ