আগৈলঝাড়া (বরিশাল) সাগরকন্যা প্রতিনিধি॥
বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা গ্রামে বাংলা সাহিত্যের অমর গ্রন্থ “মনসা মঙ্গল কাব্য” রচয়িতা, মধ্য যুগের বিখ্যাত কবি বিজয় গুপ্ত’র প্রতিষ্ঠিত ৫শ’ ২৫ বছর বছরের ঐতিহ্যবাহী মনসা মন্দিরে দেবী মনসার বাৎসরিক পূজা রবিবার (১৮ আগস্ট) সকাল নয়টায় অনুষ্ঠিত হয়ে বিকেল পর্যন্ত কয়েক দফায় অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মন্দির আঙ্গিনায় আগত ভক্ত ও দর্শণার্থীদের উদ্যেশ্যে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলামিস্ট ও আওয়ামী লীগ নেতা অজয় দাশগুপ্ত, উপজেলা চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রইচ সেরনিয়াবাত, উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি সুনীল কুমার বাড়ৈ, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবু সালেহ মো. লিটন, সাংগঠনিক সম্পাদক ও পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিপুল দাস, গৈলা ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম টিটু, মন্দির কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তারক চন্দ্র দে, সাধারণ সম্পাদক দুলাল দাশগুপ্ত, যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক অনিমেষ মন্ডল, সুশান্ত কর্মকার, কাজল দাশগুপ্ত, আশিষ তপাদার প্রমুখ।
মন্দিরের পুরোহিত রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী ও কাজল চক্রবর্ত্তী জানান, ধর্ম যার যার উৎসব সবার-এ বাক্যকে বুকে ধারণ করে মহাকবি বিজয় গুপ্ত প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে জাতি, ধর্ম, বর্ণের দেশ-বিদেশের হাজার হাজার শিশু ও নারী পুরুষ ভক্ত ও পূণ্যার্থীরা তাদের মনোবাঞ্ছা পূরণ হওয়ায় পুষ্পার্ঘ্য ও মানত নিয়ে মন্দিরে সমবেত হয়ে পুজা অর্চনা, ছাগ বলিদান, যাগযজ্ঞ, প্রার্থণা শেষে দুধ-কলা ও প্রসাদ বিতরণ করা হয়েছে।
ঐতিহাসিক মতে, ৫শ’ ২৫ বছর আগে মধ্য যুগে সুলতান হোসেন শাহ্র রাজত্বকালে তার রাজ দরবারের কবি বিজয় গুপ্ত ইংরেজী ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে নিজ বাড়িতে মনসা দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করে পূজা-অর্চনা শুরু করেন। এর পর থেকে এই মনসা মন্দিরসহ সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে মনসা পূজার প্রচলন শুরু হয়। পঞ্জিকা মতে, শ্রাবণ মাসের শেষ দিনে নাগদেবী মনসার পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বিজয় গুপ্তর জন্মতারিখ সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে জানা না গেলেও গবেষকদের ধারণা মতে, সম্ভবত ৭০ বছর বয়সে ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে কাশীধামে বিজয় গুপ্ত দেহত্যাগ করেন। বিজয় গুপ্ত রচিত পদ্মপুরাণ বা মনসা মঙ্গল কাব্যে সর্বপ্রথম ইংরেজী দিন, তারিখ ও সনের লিপিবদ্ধ করায় তাকে রাজদরবারে ‘মহাকবি’ উপাধি প্রদান করেছিলেন সুলতান হোসেন শাহ্। মহাকবি বিজয় গুপ্তের পিতার নাম সনাতন গুপ্ত ও মাতার নাম রু´িনী দেবী। বরিশাল জেলা প্রশাসন জেলার দর্শনীয় স্থানের তালিকার শীর্ষে রেখেছে ঐতিহাসিক বিজয় গুপ্তের মনসা মন্দিরের নাম। সারা বছর জুড়ে দেশ-বিদেশের পুণ্যার্থী, শিক্ষার্থী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের পর্যটনের উল্লেখযোগ্য স্থান হিসেবে রয়েছে এ মন্দিরের স্বীকৃতি।
প্রাপ্ত তথ্য ও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা গ্রামে ইংরেজি ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে বিজয় গুপ্ত জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম সনাতন গুপ্ত ও মায়ের নাম রু´িনী দেবী। বিজয় গুপ্ত ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। ৪৪ বছর বয়সে তিনি বিষহরি নাগদেবী মনসা কর্তৃক স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে তৎকালীন ফুল্লশ্রী গ্রামের মনসাকুন্ড নামে খ্যাত বর্তমান মন্দিরের পার্শ্ববর্তী দীঘি থেকে স্বপ্নে প্রাপ্ত ঘট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মন্দিরে। এরপর তিনি দেবী পদ্মা বা দেবী মনসা কর্তৃক পুনরায় স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে দীঘি সংলগ্ন সাইতান গাছের নীচে বসে নবাব হোসেন শাহ’র শাসনামলে (১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে) পদ্মপুরাণ বা মনসা মঙ্গল কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। যা পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের অমরগ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। মনসা মঙ্গল কাব্যগ্রন্থ রচনা করায় কবি বিজয় গুপ্ত সুলতানের দরবারে ‘মহাকবি’ উপাধি লাভ করেন। বিজয় গুপ্ত বিভিন্ন এলাকায় কিছুকাল সদলবলে মনসা মঙ্গল গানও করেন। এরপর তিনি তীর্থ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে কাশীধাম গমণ করেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হানাদার পাকসেনারা বিজয় গুপ্তের প্রতিষ্ঠিত মনসা মন্দিরে ব্যাপক লুটতরাজ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। শুধুমাত্র মন্দিরে বিজয় গুপ্ত প্রতিষ্ঠিত ঘটটি রেখে যায়। স্বাধীনতার পর থেকে ওই ঘটেই চলে আসছিল নিত্যদিনের পূজা-অর্চনা।
অন্যদিকে রাজিহার (চলাইরপাড়) গ্রামে মনসা সাধু নামে খ্যাত সুখদেব বিশ্বাসের বাড়ি প্রতিষ্ঠিত মনসা মন্দিরে পূজার আগের দিন বিকেল থেকে রাত জেগে দিনব্যাপি সুকদেব সাধুর অনুগত দেশ-বিদেশের হাজার হাজার ভক্ত ও শিষ্যরা জড়ো হয়ে বিভিন্ন বাদ্য বাজনা বাজিয়ে সর্পের দেবী মনসার বাৎসরিক পূজায় অংশগ্রহণ করে। এছাড়া এলাকার প্রায় সকল হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বাড়িতে বার্ষিক সার্বজনীন মনসা পূজার আয়োজন করা হয়।
এএলএস/এমআর