ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
দেশে প্রতি বছরই নতুন বেসরকারি গজিয়ে উঠছে। পুরনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাড়াচ্ছে প্রোগ্রাম। কিন্তু ওসব প্রতিষ্ঠান আশানুরূপ শিক্ষার্থী পাচ্ছে না। শিক্ষার্থী পেতে শিক্ষাবর্ষে কয়েক দফা ভর্তি কার্যক্রম চালালেও ওসব প্রতিষ্ঠানের অর্ধেকের বেশি আসনই ফাঁকা থাকছে। ইউজিসির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৭ সালে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ৫৭ শতাংশ আসনই ফাঁকা ছিল। পূর্ববর্তী বছরগুলোয়ও একই অবস্থা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে,হাতে গোনা কয়েকটি বাদে সবক’টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষার্থী সঙ্কট বিরাজ করছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আসন অনুপাতে শিক্ষার্থী না পাওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি কারণ হচ্ছে অবকাঠামো সংকট, দক্ষ শিক্ষকের অভাব ও মানহীন শিক্ষা। ইউজিসির তথ্যানুযায়ী বিগত ২০১৭ সালে দেশে অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ৯৫টি। তার মধ্যে ৫টি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার বাইরে ছিল। সেগুলো হলো সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, রবীন্দ্র সৃজনকলা, রূপায়ণ একেএম শামসুজ্জোহা, আনোয়ার খান মডার্ন ও কুইন্স ইউনিভার্সিটি। আর চালু ৯০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংখ্যা ইউজিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই। ওই ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে নর্থ সাউথ, সাউথইস্ট, সিটি, প্রাইম, সাউদার্ন, এক্সিম ব্যাংক কৃষি ও জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। বাকি ৮৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসন ও ভর্তিকৃত শিক্ষার্থী সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে দেখা যায় অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই অর্ধেকের বেশি আসনে শিক্ষার্থী নেই।
সূত্র জানায়, বিগত ২০১৭ সালে ৮৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বমোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৩৭ হাজার ১৬৬। আর ওসব বিশ্ববিদ্যালয় ওই বছর সব মিলিয়ে শিক্ষার্থী পেয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ৮৭৫ জন। ওই হিসাবে ২০১৭ সালে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অর্ধেকের বেশি আসনই খালি ছিল। শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থানে রয়েছে জেলা পর্যায়ে গড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কুমিল্লার সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৭ সালে ১ হাজার ২১০ আসনের বিপরীতে শিক্ষার্থী পায় মাত্র ৪৩ জন। নাটোরে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি ২ হাজার ২৬৫টি আসনের বিপরীতে পায় ১৫৩ জন শিক্ষার্থী। চুয়াডাঙ্গার ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ১ হাজার ৭৬৫টি আসনের বিপরীতে পেয়েছে ৪৭২ জন শিক্ষার্থী। মুন্সীগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় ১ হাজার ৭৬০টি আসনের বিপরীতে পেয়েছে মাত্র ৩২৮ জন শিক্ষার্থী। তবে ২০১৭ সালে আসন অনুপাতে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী পেয়েছিল ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। আর আসন অনুপাতে সবচেয়ে কম শিক্ষার্থী পেয়েছে সিরাজগঞ্জের খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০১৭ সালে ১ হাজার ৫৩০টি আসনের বিপরীতে শিক্ষার্থী পেয়েছে মাত্র ৩৫ জন। শুধু ২০১৭ সাল নয়, গত কয়েক বছরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কোনো বছরেই আসন অনুপাতে শিক্ষার্থী পাচ্ছে না বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ২০১৬ সালে ৯০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বমোট আসন ছিল ২ লাখ ৮৮ হাজার ৩৩২টি। ওই বছর শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল ১ লাখ ১৫ হাজার ৪৪৬ জন। অর্থাৎ ওই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ৬০ শতাংশ আসনই ফাঁকা ছিল। আর ২০১৫ সালে দেশে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমে ছিল ৮৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ওই শিক্ষাবর্ষে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলিয়ে আসন ছিল ২ লাখ ৭৯ হাজার ৮৯০টি। এর বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী পায় ১ লাখ ২০ হাজার ৮৪২ জন। এ হিসাবে ২০১৫ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৭ শতাংশ আসনই খালি ছিল। ২০১৪ সালেও শিক্ষা কার্যক্রমে থাকা ৭৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ২ লাখ ৩৫ হাজার ২টি আসনের বিপরীতে শিক্ষার্থী পেয়েছিল ১ লাখ ২১ হাজার ১৯৪ জন। অর্থাৎ ওই শিক্ষাবর্ষে আসন খালি ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৮০৮টি, মোট আসনের যা ৪৮ শতাংশ। ২০১৩ সালে শিক্ষা কার্যক্রমে থাকা ৬৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলিয়ে আসন ছিল ২ লাখ ১৪ হাজার ৩৬৯টি। এর বিপরীতে ভর্তি হয়েছিলেন ১ লাখ ১৯ হাজার ৭৬৫ জন শিক্ষার্থী। এ হিসাবে ওই শিক্ষাবর্ষে আসন খালি ছিল ৪৪ শতাংশ। তাছাড়া দেশের অন্যতম পুরনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি)। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটির ৬০ শতাংশ আসনই ফাঁকা ছিল। ওই বছর ৫ হাজার ২৫০ আসনের বিপরীতে মাত্র ২ হাজার ৬৯ শিক্ষার্থী পায় আইইউবিএটি। ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (এআইইউবি)। ২০১৭ সালে ৬ হাজার ১২০টি আসনের বিপরীতে মাত্র ৩ হাজার ৭৬৭ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন সেখানে। অর্থাৎ প্রথম দিককার এ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টিরও ৩৮ শতাংশ আসন খালি ছিল ওই বছর।
সূত্র আরো জানায়, মূলত প্রয়োজনের তুলনায় দেশে অনেক বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পাওয়ায় কেউই কাক্সিক্ষত শিক্ষার্থী পাচ্ছে না। তাছাড়া পর্যাপ্ত সংখ্যক মানসম্মত প্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠায় অনেক শিক্ষার্থীই উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। গত কয়েক বছরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। আসন অনুপাতে শিক্ষার্থী না পাওয়ার ক্ষেত্রে এটি বড় কারণ। এছাড়া একটি উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে কাঠামো ও জনবল দরকার, সত্যিকার অর্থে দেশের অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েরই তা নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বড় সুবিধা হচ্ছে, এখানে সেশনজট নেই। যদি ভালো অবকাঠামো ও যোগ্য শিক্ষক নিশ্চিত করা যেত, তাহলে শিক্ষার্থীরা কলেজে স্নাতক না করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হতো।
এদিকে শিক্ষাবিদরা বলছেন, দেশের বশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই গড়ে উঠছে রাজনীতিক কিংবা ব্যবসায়ীদের হাত ধরে। শিক্ষানুরাগী কিংবা শিক্ষাবিদদের অনুপস্থিতিতে অনেকটা অপরিকল্পিত ও অপ্রস্তুত অবস্থায় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। মৌলিক অবকাঠামো গড়ে না তুলে ভাড়া ভবনে কয়েকটি কক্ষ ও হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষক নিয়েই শুরু করা হচ্ছে কার্যক্রম। এমনকি কার্যক্রম শুরুর পরও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার কলেবর বাড়ানো হয় না। এসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না বলে মনে করেন ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান জানান, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি হতে শিক্ষার্থীদের তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয়। ভিন্ন চিত্র দেখা যায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়েই কোনো ধরনের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় না। তার পরও শিক্ষার্থী পাচ্ছে না বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এক্ষেত্রে মৌলিক সুবিধাদি গড়ে না ওঠা, যোগ্য শিক্ষকের অভাব শিক্ষার্থী না পাওয়ার অন্যতম কারণ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নামমাত্র ফি দিয়ে ডিগ্রি পাওয়া যায়। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ডিগ্রি পেতে শিক্ষার্থীদের মোটা অঙ্কের ফি-বেতন দিতে হয়। তাই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে খুব সচেতন। যাচাই-বাছাই করেই তারা সেখানে ভর্তি হয়। তাই শিক্ষার গুণগত মান ও শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। তবে কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সন্তোষজনক।
এ প্রসঙ্গে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আখতার হোসেন এ বিষয়ে জানান, দেশের ১০-১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যেগুলো খুবই ভালো করছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ-সুবিধা অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও ভালো। তবে শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগই চলছে উল্টো পথে। তাদের অবকাঠামো খুবই নি¤œমানের। শিক্ষক তো নেই বললেই চলে। এই যখন অবস্থা, তখন শিক্ষার্থী না পাওয়াটাই স্বাভাবিক। শিক্ষার্থীরা এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায়, যেখান থেকে বের হওয়ার পর ভালো কর্মসংস্থান হবে। মানহীন বিশ্ববিদ্যালয়ের মানহীন ডিগ্রি নিয়ে চাকরির বাজারে মূল্যায়িত না হওয়ার ভয়েই তারা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে না। মূলত গুণগত মানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে না পারায় আসন অনুপাতে শিক্ষার্থী পাচ্ছে না বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
এফএন/এমআর