মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) সাগরকন্যা অফিস॥

পঞ্চম পেরিয়ে থমকে যায়। অভাবের তাড়নায় ঢাকায় গিয়ে সুতার কারখানায় কেটেছে দুইটি বছর। হাল ঠেলেছে সংসারের। ষষ্ঠ, সপ্তম শ্রেণির লেখাপড়া হয়নি। দারিদ্র্য যেন সব পথ রুদ্ধ করে দেয়। কিন্তু দমেনি সে। জীবিকার যুদ্ধের লড়াই যতোই কঠিন ছিল শিক্ষার স্বপ্ন কখনও মন থেকে মুছে যায়নি। ধুসর, বিবর্ণ জীবনে লেখাপড়ার রঙিন স্বপ্নের জাল বুনত। ভর্তি হয় অষ্টমে, বাড়ির এলাকা চরচাপলী ইসলামিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ছিল জমানো কিছু টাকা। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শুরু করে টিউশনি। সীমাহীন কষ্টে এসএসসি পাশ। কিন্তু সাফল্য শতভাগ। জিপিএ-৫।
হতাশার রাজ্যে আশার আলো। টিউশনির জমানো ১২ শ’ টাকায় কলেজে এইচএসসসিতে ভর্তি হয়। কিন্তু এখন আর চলেনা। বিজ্ঞান বিভাগের বইসহ সকল খরচ কীভাবে, কোথা থেকে জোটাবে তা ভেবে সব অন্ধকার দেখছে। কাটে বিনিদ্র রাত। পুরো নাম মানসুরা মীম। বাবা নাসির হাওলাদার রিক্সা চালান। মা জাকিয়া বেগম নানান জটিল রোগে শয্যশায়ী। টানা দুই মাস হাসপাতালে চিকিৎসার পরে এখন বাড়িতে পড়ে আছেন। উন্নত চিকিৎসা তো দুরের কথা, ওষুধ ঠিকমতো চলে না। পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার চরচাপলী গ্রামে মীমের বাড়ি। বাড়ি বলতে এক চালের একটি ঘর। সঙ্গে বারান্দা।
শ্রমজীবী বাবার আয়ে চারজনের পেটের যোগান চলেনা। মায়ের চিকিৎসা আটকে আছে। এক ভাই পঞ্চম শ্রেণির আলাইহীমের লেখাপড়াও অনিশ্চিয়তার দোলাচলে। এখন সংসারের রান্নার কাজ, অসুস্থ মায়ের সেবা করা। টিউশনি করতে সময় বের করা। এরপরে নিজের লেখাপড়ার সময়। এতেই মীমের অবস্থা ত্রাহি। বই কেনা হয়নি। কবে কিনবে জানেও না। আর্থিক দৈন্য যেন কোমলমতি কিশোরী মেয়েটির টুটি চেপে ধরেছে। বোঝাতে পারেনা কতোটা অসহায় তার আগামির পথচলা। যেন দু’চোখে সব অন্ধকার দেখছে মেধাবী মীম। মায়ের চিকিৎসার অসহায়ত্বে মীম ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে কখনও। কিন্তু স্বপ্ন কী বাস্তবে পরিণত হবে! এমন কোন সম্ভাবনার আলো দেখছেনা মীম। সব যেন ফের স্বপ্নেই মিলে যায়।
একরাশ হতাশা নিয়ে কিশোরী মীম বলে, হয়তো শ্রমিক হতাম। নিজের খেয়ালে এখন কলেজের ছাত্রী। যেন নতুন যুদ্ধে নেমেছে সে। যেখানে জয়ী হওয়ার কোন পথ জানা নেই। মীমের ভাষ্য, ‘কতোই না কষ্ট করেছি। উপোস কিংবা আধাপেট পুরে দিনের পর দিন পার করেছি। তারপরও ভাল ফলাফল করেছি। কিন্তু এখন সামনের পথ খুজে পাইনা।’ মীমের কথায় যেন নিজের গলাও আটকে যাচ্ছিল। শুধুই অসহায়ত্ব ওকে তাড়া করছে। যেখানে দৌড়ানোর কিংবা পালানোর কোন পথ ওর জানা নেই। শুধুই মোকাবেলার পথ খুঁজছে হত-দরিদ্র পরিবারের এ মীম। কোমর সোজা করে শিক্ষা জীবনের লড়াইয়ে টিকে থাকার আকুতি তার। নইলে একটি মেধাবী মুখ ছিটকে পড়বে সমাজ থেকে। হারিয়ে যাবে চীরদিনের জন্য।
মা জাকিয়া বেগম বলেন, মীমের মতো কষ্ট করে কেউ পড়বে না। শিক্ষক নুরুন্নবী জানান, মীম খুবই মেধাবী। কিন্তু ওর পরিবারে এখন ঠিকমতো খাওয়া জোটে না, সেখানে লেখাপড়ার কী হবে; ভাবতেই খারাপ লাগে। সমাজের বিত্তবান, হৃদয়বান মানুষ এগিয়ে আসলে মীমের লেখপড়ার পথ সচলের সম্ভাবনা রয়েছে। নইলে মেধাবী মীমের শিক্ষাজীবন থমকে যাওয়ার প্রবল শঙ্কা রয়েছে।

এমইউএম/এমআর