গোপালগঞ্জ সাগরকন্যা প্রতিনিধি॥
দেশে এখন বিলুপ্তপ্রায় তালপাতার পাঠশালা। একসময় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের উত্তম ক্ষেত্রই ছিল এই তালপাতার পাঠশালা। শিশু-শিক্ষার্থীরা প্রাইমারী স্কুলে যাওয়ার আগে বর্ণমালা, শতকিয়া, নামতা, ফলা ও বানানরীতিসহ প্রাক-প্রাথমিক নানা শিক্ষা পেত এই পাঠশালা থেকে। শুধুমাত্র গরীব হত-দরিদ্রের ছেলেমেয়েরাই নয়; স্বচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েরাও যেতো তালপাতার পাঠশালায়। সবাই একসঙ্গে এক তালে সুর মিলিয়ে পড়তো আর রান্নার হাড়ির নীচের কালি ও বাঁশ-কুঞ্চির বানানো কলম দিয়ে তালপাতায় লিখে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা নিত এই পাঠশালা থেকে। তালপাতায় লিখলে হাতের লেখা সুন্দর হয়, শিক্ষার্থীরা মনোযোগী থাকে, আগ্রহভরে শিক্ষা নেয় এবং খরচও অল্প - এমন ধারণায় উদ্বুদ্ধ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বড় ডুমুরিয়া গ্রামের বাসিন্দারা আজও ধরে রেখেছেন এমন একটি তালপাতার পাঠশালা।
দীর্ঘ ২৫ বছর আগে ধীরেন্দ্রনাথ মৃধা নামে এক শিক্ষানুরাগী স্থানীয় একটি ক্লাবঘরে শুরু করেছিলেন এই পাঠশালাটি। তার মৃত্যুর পর স্থানীয় শিক্ষক মীরা কীর্ত্তণীয়া ধরে রাখেন প্রায় ১৫ বছর। গত ৬ বছর ধরে স্থানীয় রাধা-গোবিন্দ-হরি-দুর্গা সার্বজনীন মন্দির প্রাঙ্গণে এই পাঠশালায় শিক্ষা দিচ্ছেন তার নাত-বৌ কাকলী কীর্ত্তণীয়া। বর্তমানে তার পাঠশালায় শিক্ষারত আছে অর্ধশতাধিক কোমলমতি শিশু। তারা মন্দির প্রাঙ্গণে খোলা জায়গায় মাটিতে বসে শিক্ষা গ্রহণ করছে। তালপাতায় শিক্ষকের এঁকে দেয়া বর্ণমালার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তারা লেখা শেখে। হাতে-মুখে কালি মেখে আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে শিক্ষা নেয়। পাঠশালাটি শুরু হয় সকাল ১০টায় - চলে দুপুর ২টা পর্যন্ত। একই সঙ্গে শিশুদের পড়ার সুরে সকাল থেকেই মূখরিত হয়ে ওঠে পাঠশালাসহ আশপাশ। পাঠশালাটির শিক্ষার্থীরা একসময় লেখাপড়ার খরচ হিসেবে দিত বাৎসরিক এক মন ধান। এখন তারা দেয় মাসিক ১’শ টাকা। এ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় পাঠশালার শিক্ষক কাকলী কীর্ত্তণীয়াকে। এলাকাবাসীর প্রত্যাশা, যুগের স্বাক্ষী এ তালপাতার পাঠশালাটি আমাদের ঐতিহ্য বহন করবে।
পাঠশালার একমাত্র শিক্ষক কাকলী কীর্ত্তণীয়া জানান, স্থানীয় মুরুব্বীদের সহযোগিতায় তিনি পাঠশালাটি চালিয়ে যাচ্ছেন। বড় ডুমুরিয়া, ছোট ডুমুরিয়া, ভৈরব নগর, ভেন্নাবাড়ি, শালুখা ও তাড়াইল সহ আশপাশ এলাকার হত-দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা এ পাঠশালায় পড়াশুনা করছে। ‘আদি বাল্য শিক্ষা’ নামে যে বইটি রয়েছে, তা থেকেই বয়সভেদে তিনি শিশুদেরকে বর্ণমালা, শতকিয়া, নামতা, ফলা ও বানানরীতি শিক্ষা দিয়ে থাকেন। শিশুরাও যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। পড়ালেখার পাশাপাশি তারা গান, কবিতা, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাও চর্চা করছে। পাঠশালার পাঠ চুকিয়ে তারা ভর্তি হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিন্তু পাঠশালার কোন নিজস্ব স্থান না থাকায় মন্দিরের খোলা জায়গায় পড়াতে হয়। মন্দিরে কোন অনুষ্ঠান থাকলে পাঠশালা বন্ধ রাখতে হয়। নেই বাইরের সাহায্য-সহযোগিতা। নেই শিক্ষার্থীদের স্কুল-ব্যাগ, টিফিন বা বিনোদন ব্যবস্থা। বিনা বেতনসহ শিশুদের এসব চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হলে শিক্ষার্থীরা পড়াশুনায় আরও মনোযোগী হতো এবং পাঠশালাটিও তার সুন্দর পরিবেশ ফিরে পেতো।
প্রাচীণ ঐতিহ্যবাহী এ তালপাতার পাঠশালাটি সরকারি সহযোগিতাসহ তার নিজস্ব ঠিকানা পাবে - এমন প্রত্যাশা জানিয়ে গোপালগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আবদুল্লাহ আল বাকী জনকণ্ঠকে বলেছেন, এখনও তালপাতার পাঠশালা গোপালগঞ্জে চলমান আছে শুনে ভাল লাগলো। আমি নিজে সেখানে গিয়ে বাস্তব অবস্থা দেখব এবং যথাযোগ্য কর্তৃপক্ষকে অবহিত করব। পাঠশালাটি যদি ধরে রাখা যায়, বাংলার ঐতিহ্যে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলবে এবং আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে আমরা এর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির জন্য অবশ্যই সহযোগিতা করব।
এইচবি/এমআর