সাগরকন্যা এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট॥
শিক্ষক সঙ্কটে ব্যাহত হচ্ছে দেশের ৩ ডজন সরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম। ওসব প্রতিষ্ঠান কোনোভাবেই শিক্ষক সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মানসম্পন্ন চিকিৎসক তৈরির পরিকল্পনা। তাছাড়া কর্মরত সরকারি শিক্ষকদের অনেকেই বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে শিক্ষাদানসহ ব্যক্তিগত বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত থাকেন। ফলে সরকারী কলেজগুলোর স্বাভাবিক শিক্ষাদান আরো বেশি ব্যাহত হয় বলে অভিযোগ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। মেডিকেল শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের সব সরকারি মেডিক্যাল কলেজেই শিক্ষক সঙ্কট রয়েছে। পাশাপাশি নতুন কয়েকটি কলেজ স্থাপন হওয়ায় তা আরো প্রকট হয়ে উঠেছে। বর্তমানে দেশের শতকরা ৭৭ ভাগ সরকারি মেডিক্যাল শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। ওসব মেডিক্যাল কলেজে ৫ হাজার ৫৮২ জন শিক্ষক প্রয়োজন হলেও আছেন মাত্র ১ হাজার ৩০৩ জন। ফলে শিক্ষক সঙ্কটে মেডিক্যাল শিক্ষাদান মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, দেশের সরকারি ৩০ মেডিক্যাল কলেজগুলোতে মৌলিক বিষয় পড়ানোরও পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। পুরনো ৮ মেডিক্যাল কলেজ ছাড়া অন্যগুলোতে তীব্র শিক্ষক সঙ্কট রয়েছে। বিশেষ করে মৌলিক বিষয় এ্যানাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, ফার্মাকোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, প্যাথলজি, ফরেনসিক মেডিসিন ও কমিউনিটি মেডিসিন বিষয়ে শিক্ষক সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে। আর ২০০৮ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত ১৪ মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষক সঙ্কট আরো তীব্র।
সূত্র জানায়, শিক্ষক সঙ্কটের শীর্ষে রয়েছে পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ। ওই প্রতিষ্ঠানে মাত্র ৯ জন শিক্ষক রয়েছেন। মেডিক্যাল কলেজটিতে ফার্মাকোলজি বিভাগে একজন শিক্ষকও নেই। এ্যানাটমি, বায়োকেমিস্ট্রি এবং কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগে রয়েছেন একজন করে সহকারী অধ্যাপক। ফিজিওলজি বিভাগে একজন সহযোগী অধ্যাপক এবং দু’জন লেকচারার রয়েছেন। মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে একজন সহযোগী অধ্যাপক এবং ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে একজন করে সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপক রয়েছেন। তাছাড়া ১৭ জন করে শিক্ষক রয়েছে সিরাজগঞ্জ ও নোয়াখালী মেডিক্যাল কলেজে। টাঙ্গাইল মেডিক্যালে ১৮ জন, জামালপুরে ১৯ জন, কুষ্টিয়ায় ২০ জন এবং শেখ সায়েরা খাতুন মেডিক্যাল কলেজ, সাতক্ষীরা মেডিক্যাল, পাবনা মেডিক্যাল কলেজে ২১ জন করে শিক্ষক রয়েছেন। মুগদা মেডিক্যাল কলেজে ২৩ জন, রাঙ্গামাটি ও মানিকগঞ্জ মেডিক্যাল কলেজে ২৫ জন করে, দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজে ২৯ জন শিক্ষক রয়েছেন। কক্সবাজার ও যশোর মেডিক্যাল কলেজে ৩২ জন করে শিক্ষক রয়েছেন। ওসব মেডিক্যাল কলেজে অনেক বিভাগে অধ্যাপক নেই। খুলনা মেডিক্যালে ছয় ব্যাচে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮৬১। সেখানে ১৯টি বিষয়ে কোন অধ্যাপক নেই। ৯টি বিষয়ে মাত্র একজন করে শিক্ষক থাকলেও, ৪টি বিষয়ে তাও নেই। ২৩ অধ্যাপক পদের বিপরীতে ৪ আর ৪৪ সহকারী অধ্যাপকের মধ্যে দায়িত্বে রয়েছেন মাত্র ৮ জন। পাবনা মেডিক্যাল কলেজে ফিজিওলজি, এ্যানাটমি ও বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগ চলছে মাত্র একজন প্রভাষক দিয়ে।
সূত্র আরো জানায়, বিভিন্ন কারণে পর্যাপ্ত দক্ষ চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে না। অনেক মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষক, মেডিক্যাল উপকরণ ও রোগীর সঙ্কট রয়েছে। হাসপাতাল, রোগী ও পর্যাপ্ত মেডিক্যাল উপকরণ না থাকায় শিক্ষার্থীরা প্রাকটিক্যাল দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়ে। এমন অবস্থায় নতুন মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। তাছাড়া মেডিকেল কলেজের শিক্ষকদের যোগ্যতাও ভালভাবে মনিটরিং করা হয় না। একজন শিক্ষককে শিক্ষাদান ও চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হয়। অনেক সময় শিক্ষকদের শিক্ষাদানের তুলনায় চিকিৎসাদানে বেশি সময় দিতে হয়। আবার অনেক শিক্ষক একাধিক মেডিক্যাল কলেজে সম্পৃক্ত থাকেন। নিম্নমানের কলেজ থেকে বের হয়ে একজন দক্ষ চিকিৎসক এবং মানসম্মত চিকিৎসাসেবা দেয়া সম্ভব নয়। এ ধরনের চিকিৎসকরা অনেক সময় জাতির জন্য হুমকি হয়ে ওঠেন।
এদিকে এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কামরুল খান সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশের মেডিক্যাল শিক্ষা ত্রয়ী প্রশাসনে তখনো ছিল, এখনো আছে। ত্রয়ী প্রশাসন মানে, বিএমডিসি (বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল) কোর্স কারিকুলাম করে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরীক্ষা নীতি ও বদলি করে থাকে এবং সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরীক্ষা নিয়ে তারা সনদ প্রদান করে। ত্রয়ী প্রশাসন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় দরকার ছিল।
অন্যদিকে শিক্ষক সঙ্কট প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক পদোন্নতি ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষক সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা চালানো হবে উল্লেখ করে বলেন, যাদের ডিও হয়ে গেছে তাদের প্রমোশন দেয়া হচ্ছে। প্রমোশন দিলে তারা শিক্ষক হতে পারবেন। শিক্ষক নিয়ে যে সঙ্কটের মুখে পড়েছে মেডিক্যাল কলেজগুলো, তা শনাক্ত করে শীঘ্রই তার সমাধান করা হবে।
এফএন/এনইউবি