ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুতগতির যোগাযোগ ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষ চিঠিতে আগ্রহ হারাচ্ছে। আর যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এ পরিবর্তনের সাথে নিজেদের বদলাতে না পারায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে ডাক বিভাগ। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ওই প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছর গড়ে প্রায় তিনশ কোটি টাকার লোকসান গুনছে। যদিও ক্ষতি ঠেকাতে ডাক বিভাগে কুরিয়ার, পার্সেল, মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করা হয়েছে। কিন্তু যথাযথ বাণিজ্যিক পরিকল্পনা না থাকায় ডাক বিভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। বর্তমানে রাষ্ট্রীয় ডাক ও প্রাতিষ্ঠানিক ডাক ছাড়া চিঠি আদান-প্রদান প্রায় শূন্যের কোঠায়। মূলত নব্বইয়ের দশকের পর ডাক বিভাগ তার জৌলুস হারিয়েছে। এখন ডাক বিভাগের ৯ হাজার ৮৮৬ ডাকঘর ধুঁকছে। আর দেড় দশকে ডাক বিভাগে চিঠি বিলির সংখ্যা কমেছে ২০ কোটি। ডাক বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, জন্ম থেকে ডাক বিভাগ কখনো লাভের মুখ দেখেনি। বিগতবছরও ডাক বিভাগের ৪৩৬ দশমিক ৩৬ কোটি টাকার ঘাটতি রয়েছে। বিগত ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে ১ দশমিক ৫৯৮ কোটি টাকা লোকসান দিয়ে যাত্রা শুরু করে ডাক বিভাগ। এখন সংস্থাটির লোকসানের পাল্লা বছরে ৪০০ কোটি ছাড়িয়েছে। সংস্থাটির ঘাটতির পরিমাণ বছর বছর লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। ১৯৭১-৭২ অর্থবছর লোকসান ছিল ১ দশমিক ৫৯৮ কোটি টাকা। ১০ বছরের মাথায় ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে ওই লোকসান দাঁড়ায় ৬ কোটিতে, ১৯৯১-৯২ অর্থবছরে ৩০ দশমিক ১৯ কোটি, ২০০১-০২ অর্থবছরে ৮১ দশমিক ৯৪ কোটি, ২০১১-১২ অর্থবছরে ২০০ দশমিক ৬৯ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে লোকসান দাঁড়ায় ৪৬২ দশমিক ৩৭২ কোটি টাকা। ১৯৭১-২০১৮ পর্যন্ত ৪৭ বছরে লোকসান করে ৪ হাজার ১৪০ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। আর ব্যয়ের বড় অংশই খরচ হয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও বিভিন্ন সুবিধার পেছনে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সংস্থাটি রাজস্ব আয় করে ৩৭৪ দশমিক ২২৮ কোটি টাকা। সেখানে ব্যয় হয় ৮৩৬ দশমিক ৬ কোটি টাকা। ৭৭১ কোটি টাকা খরচ হয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ডাক বিভাগের মোট রাজস্ব আয় ৪০৪ দশমিক ৯৩ কোটি টাকা এবং ব্যয় হয়েছে ৮৪১ দশমিক ২৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছরেও ৪৩৬ দশমিক ৩৬ কোটি টাকা ঘাটতিতে রয়েছে ডাক। সারা দেশে ডাকঘরে কর্মরত ৩৯ হাজার ৯০৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্দিন আরো ঘনীভূত হচ্ছে। তাদের প্রায় ২৪ হাজার ভাতাপ্রাপ্ত কর্মচারীই হলেন রানার বা ডাক হরকরা, যাদের অবস্থা বড়ই করুণ।
সূত্র জানায়, বর্তমানে ডাক বিভাগের সেবার মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ ডাক সেবা, আন্তর্জাতিক ডাক সেবা, এক্সপ্রেস মেইল সার্ভিস (ইএমএস), গ্যারান্টিড এক্সপ্রেস পোস্ট, সঞ্চয় ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র, ডাক জীবন বীমা, মানি অর্ডার, পোস্টাল অর্ডার। তাছাড়া আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিতে ডাক বিভাগ নতুন বেশ কিছু সেবা নিয়ে এসেছে। তার মধ্যে রয়েছে ক্যাশকার্ড, ইএমটিএস, ইএমটিএস রেট, স্পিড পোস্ট এবং মোবাইল ব্যাংকিং সেবা নগদ। গতবছরের ২৮ সেপ্টেম্বর মোবাইল অ্যাপসভিত্তিক সেবা অবমুক্ত করে ডাক বিভাগ। গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত প্রায় এক লাখেরও বেশি মানুষ সেটি ডাউনলোড করেছে।
সূত্র আরো জানায়, বিগত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ডাক বিভাগের পত্র আদান-প্রদানের সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৫৪ লাখ ৩৮ হাজার ৩১০টি। এক বছর পার হতেই ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পত্র আদান-প্রদানের সংখ্যা কমে ৪ কোটি ১৭ লাখ ৮১ হাজার ১১৫টিতে দাঁড়ায়। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পার্সেল আদান-প্রদানের সংখ্যা ছিল ৪২ লাখ ৫৬ হাজার ৩৬৮টি। কিন্তু ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পার্সেলের সংখ্যা কমে ৩৬ লাখ ৭৫ হাজার ৬৪২টিতে দাঁড়ায়। ডাক বিভাগের বার্ষিক প্রতিবেদনে উন্নয়নের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এদিকে ডাক বিভাগের প্রযুক্তি বিষয়ে প্রযুক্তিবিদদের রয়েছে নানা অভিযোগ। তাদের মতে, প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমানে বাংলাদেশের লাখো যুবক ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে দেশে বসে বহির্বিশ্বের কাজ করছে। কেউ অনলাইন পোর্টাল খুলে গুগল অ্যাডসেন্স অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন এনে রোজগার করছে। কেউ সফটওয়্যারসহ বিভিন্ন সেবা অনলাইনে দেশে-বিদেশে বিক্রি করছে। সেই সঙ্গে ই-কমার্সের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য কিনছে এবং বিক্রি করছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে ডাক বিভাগের গাফিলতির কারণে সংশ্লিষ্টদের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। কারণ ডাক বিভাগের গাফিলতির কারণে গুগল অ্যাডসেন্স অ্যাকাউন্ট করতে বেগ পেতে হচ্ছে। গুগল অ্যাডসেন্স থেকে ডাকের মাধ্যমে ঠিকানা যাচাইয়ের জন্য পিন পাঠায়। অনেক সময় সেই পিন হাতে এসে পৌঁছায় না। আবার পৌঁছালেও বিলম্বে। আর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই পিন না পেলে অ্যাডসেন্স অ্যাকাউন্ট করা যায় না। তাছাড়া ফ্রিল্যান্সিং থেকে উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পাইয়োনিয়ার কার্ডের মাধ্যমে তুলতে হয়। ওই কার্ড বিদেশ থেকে ডাকের মাধ্যমে আসে। কিন্তু অনেকেরই পোস্ট অফিস থেকে ওই কার্ড হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ওসব কারণে দেশে ও দেশের বাইরে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে ডাক বিভাগ।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার জানান, সরকারের সব প্রতিষ্ঠান লাভজনক হয় না। তাই যদি হতো তাহলে সরকার বিনামূল্যে বই দিত না। ডাকও তেমনই একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। তবে আগের তুলনায় এখন ডাকের উন্নয়ন ঘটেছে, ভবিষ্যতে আরো হবে।
এফএন/এমআর