কলাপাড়া (পটুয়াখালী) সাগরকন্যা অফিস॥
বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত সাগরপারের জনপদ কুয়াকাটা। ভ্রমণ বিলাসি ও পর্যটকদের আনন্দ ভ্রমনের অন্যতম মনোরম ও মনোমুগ্ধকর জায়গা হল সাগরকন্যা কুয়াকাটা। এখানে আসলে প্রাকৃতিক শোভামন্ডিত দৃশ্যপট অবলোকনের পাশাপাশি দেশের প্রাচীন পুরাকীর্তি বিভিন্ন বৌদ্ধবিহার ও প্রাচীন কুয়া স্বচক্ষে দেখার সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি একই জায়গায় দাড়িয়ে বার ঘন্টার ব্যবধানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মনোরম সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। নিজের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করতে কুয়াকাটা ভ্রমনের বিকল্প নেই।
দীর্ঘ ১৮কিলোমিটার এ সৈকতে রয়েছে চোখ ধাধানো সুন্দরের সমাহার। রয়েছে লাল কাকড়ার অবিরাব ছোটাছুটি। সাথে দেখা যায় সূর্যের সাথে সমুদ্রের নোনা জলের গভীর মিতালির দৃশ্য। আবার দেখা যায় সাগর থেকে ভেসে আসা বালুর সাথে মিশে থাকা অসংখ্য ছোট বড় ঝিনুক। এছাড়া রয়েছে ফয়েজ মিয়ার বাগানের বড় বড় নারিকেল গাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট বড় ফলদ বৃক্ষের সমাহার। রয়েছে আন্ধার মানিক নদীসহ তিন মোহনার দৃশ্য। আর এ আন্ধার মানিক মোহনার উল্টোদিকে রয়েছে ফাতরার বিশাল বনাঞ্চল, শুটকি পল্লী, লাল কাকড়ার চর ইত্যাদি। নতুন করে সাগরের মাঝে জেগে উঠেছে চর বিজয়। আর এ চর বিজয়ে রয়েছে অসংখ্য লাল কাকড়াসহ দেশী বিদেশী বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। কুয়াকাটা সী-বীচের অদুরেই রয়েছে পর্যটনপল্লী গঙ্গামতি সৈকত।
কুয়াকাটার অবিচ্ছেদ্য অংশ এখানকার আদি বাসিন্দা উপজাতি রাখাইন সম্প্রদায়। এদের ভিন্ন আদলের জীবনযাত্রা অবলোকনের সুযোগ মনে এনে দেয় ভিন্ন মাত্রার অনুভূতি। প্রায় সোয়া ২০০শ বছর আগে আরাকান থেকে বিতাড়িত দেড়শ রাখাইন পরিবার নৌকায় ভাসতে ভাসতে সাগরপারে নোঙ্গর করে। স্বাপদ-শঙ্কুলের এ জনপদে গড়ে তোলেন প্রথম মানব বসতি। খাওয়ার নিরাপত পানি ছিলনা তাই রাখাইন পরিবার গুলো কুয়া খনন করে মিঠা ও নিরাপদ পানি সংগ্রহ করেন। সেই কুয়ার নামানুসারে আজকের কুয়াকাটার নামকরন। চোখে পড়বে এদের তাঁতসহ উল বুনন কার্যক্রম। সুযোগমিলবে অন্যতম সৌন্দর্য ইন্দোচীনের আদলে রাখাইনদের শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধবিহার দর্শনের। এছাড়া কুয়াকাটার অদুরে মিশ্রিপাড়ায় রয়েছে সীমা বৌদ্ধবিহার। এ বিহারের মধ্যে গৌতম বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন ১৩৭ মন ওজনের অষ্টথাতু নির্মিত বিশাল আকৃতির বৌদ্ধমুর্তি শোভা পাচ্ছে। রাখাইনদের মতে এটি এশিয়ার বৃহত্তম বুদ্ধমুর্তি। রূপসী কুয়াকাটার নৈসর্গিক রূপ অন্যান্য সৈকতের বহুলাংশে আকর্ষনীয়। অবলোকন করা যাবে জেলেদের ঢেউয়ের সঙ্গে মিতালী করা জীবন-জীবিকার যুদ্ধ ।
পরিচ্ছন্নতার জন্য রয়েছে কুয়াকাটার আলাদা পরিচিতি। সুন্দরের স্বকীয়তায় কুয়াকাটাকে বলা হয় সাগর কন্যা। এছাড়া পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের অতিথিয়েতায় মুগ্ধ হন পর্যটকরা। তাই প্রতিদিন শত শত পর্যটক-দর্শনার্থীর ভীড়ে মুখরিত থাকছে কুয়াকাটা। আর এই ঈদের লম্বা ছুটিতেও পর্যটকদের থাকবে উপচে পড়া ভীড় থাকবে বলে ধারনা করছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। বেলাভূমির সর্বত্র হৈ-হুল্লুরে মেতে উঠবে পর্যটকরা। নির্মল আনন্দ আর গভীর প্রশান্তি পেতে যারাই কুয়াকাটা আসবে তারাই পাবে প্রকৃতির সান্নিধ্য। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য শুধু মানুষকে মুগ্ধই করেনা, ক্লান্তি-মনের জড়তা ঘুচিয়ে দেয়। তাই জীবনের আমুদে আর প্রশান্তির সময় কাটাতে ও মুহুর্তগুলো স্মরনীয় করতে কুয়াকাটায় ভ্রমনের বিকল্প নেই।
১৯৭২ সালে শেখ মুজিবর রহমান প্রাথমিকভাবে কুয়াকাটার উন্নয়নে দুই দশমিক ৩৩একর জমি অধিগ্রহন করেন। করেন কুয়াকাটার উন্নয়নের গোড়াপত্তন। জিয়াউর রহমান সরকার ১৯৮১ সালে মন্ত্রিসভায় এক সভা করে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার সিদ্ধান্তকে এগিয়ে নেন। ১৯৯৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে কুয়াকাটার উন্নয়নে আরও পাঁচ একর জমি অধিগ্রহন করে, এক কোটি বিশ লাখ টাকা ব্যয়ে পর্যটন কর্পোরেশনের হলিডে হোমস নির্মানের দরপত্র আহ্বান করা হয়। বৌদ্ধবিহার এলাকায় বাউন্ডারি দেয়া হয়। করা হয় রাখাইন মার্কেট, রাখাইন কালচার একাডেমী, দরিদ্র রাখাইনদের জন্য আশ্রয়ন প্রকল্প। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন এ প্রতিষ্ঠানের। তখনই কুয়াকাটাকে তিনি ঘোষনা করেন আধুনিক পর্যটন কেন্দ্রে উন্নীতের। নেয়া হয় খাজুরা থেকে গঙ্গামতি এলাকাকে ইটিজেট অধীন। কুয়াকাটার ঐতিহাসিক কুয়া সংরক্ষনের উদ্যোগ নেয়া হয়। সেই থেকে কুয়াকাটার নাম শুধু দেশে নয়, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পর্যটক-দর্শনার্থীদের হুমড়ি খেয়ে পড়ে রূপসী কন্যা কুয়াকাটার সৌন্দর্য উপভোগ করতে। এক চিলতে জমি কেনার জন্য ছুটতে থাকেন ব্যক্তিসহ বেসরকারী বিনিয়োগকারীরা। ২০০৮ সাল থেকে কুয়াকাটায় ঢল নামে দেশের প্রথিতযশা বিনিয়োগকারীদের।
জেলা সদর পটুয়াখালী থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত মসৃন সড়ক নির্মান সম্পন্ন করা হয়েছে। নতুন করে ফোর লেন সড়ক নির্মানের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কুয়াকাটায় রয়েছে পর্যটক-দর্শনার্থীদের জন্য আধুনিক ও অত্যাধুনিক অসংখ্য হোটেল মোটেল। দেড় কিলোমিটার পূর্ব রয়েছে মনকাড়া সিকদার রিসোর্ট এন্ড ভিলা সৈকতের পাশেই রয়েছে হোটেল গ্র্যান্ড। তাছাড়া ইলিশের পেটে বসে ইলিশ খাওয়ার সুযোগ। পার্কের মধ্যে ইলিশ পার্ক, স্বপ্ন রাজ্য সহ আরও বেশ কয়েকটি পার্ক রয়েছে। সম্পন্ন হয়েছে দেশের দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবল ল্যান্ডিং নির্মানের কাজ। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিচ্ছে ট্যুরিস্ট পুলিশ।
ঢাকা থেকে কুয়াকাটার দূরত্ব ৩২০ কি.মি.। বরিশাল থেকে ১০৮ কি.মি.। জেলা শহর পটুয়াখালী থেকে ৭০ কি.মি. এবং উপজেলা সদর কলাপাড়া থেকে ১৮ কি.মি.। কুয়াকাটার সঙ্গে এখন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসি-ননএসি পরিবহন বাস চলাচল করছে। প্রতিদিন গাবতলী কিংবা সায়েদাবাদ থেকে দিবা-নৈশ বাস চলাচল করছে। ঢাকা থেকে পটুয়াখালী জেলা সদর পর্যন্ত সরাসরি লঞ্চ যোগাযোগ রয়েছে। সেখান থেকে রয়েছে সরাসরি কুয়াকাটার বাস। তারপরও কুয়াকাটায় আসতে-যেতে কিংবা থাকতে কারও সমস্যা হলে যোগাযোগ করতে পারেন কুয়াকাটা হোটেল মোটেল এসোসিয়েশন কতৃপক্ষ কিংবা কুয়াকাটা ট্যুর অপারেটরের (টোয়াক) সঙ্গে।
ইএইচ/এমআর