১২ দিনের সফরে জাপান গেলেন প্রধানমন্ত্রী

প্রথম পাতা » জাতীয় » ১২ দিনের সফরে জাপান গেলেন প্রধানমন্ত্রী
মঙ্গলবার ● ২৮ মে ২০১৯


১২ দিনের সফরে জাপান গেলেন প্রধানমন্ত্রী

ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥


টোকিওতে ‘দ্য ফিউচার অব এশিয়া’ সম্মেলনে যোগ দিতে ১২ দিনের সরকারি সফরে জাপান গেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মঙ্গলবার (২৮ মে) সকাল ৯টা ১০ মিনিটে বাংলাদেশ বিমানের একটি ভিভিআইপি ফ্লাইটে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সফরসঙ্গীদের নিয়ে রওনা হন তিনি। ১২ দিনের এই সরকারি সফরে জাপান থেকে সৌদি আরব ও পরে ফিনল্যান্ডে যাবেন প্রধানমন্ত্রী। সেখান থেকে ঈদের পর ৮ জুন তার ঢাকায় ফেরার কথা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী টোকিও সফরে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন; তাদের উপস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে আড়াই বিলিয়ন ডলারের একটি ঋণ চুক্তি হওয়ার কথা রয়েছে। জাপানি সম্প্রচারমাধ্যম নিকেই-এর আয়োজনে ‘দ্য ফিউচার অব এশিয়া’ সম্মেলনে বক্তব্য দেবেন শেখ হাসিনা।
এ সম্মেলনকে এশিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ওইআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে জাপান থেকে শেখ হাসিনা যাবেন সৌদি আরবে। সেখানে তিনি ওমরাহ পালন করবেন এবং মদীনায় মহানবীর (সঃ) রওজা জিয়ারত এবং মসজিদে নববীতে নামাজ আদায় করবেন। সৌদি আরব থেকে শেখ হাসিনা যাবেন ফিনল্যান্ডে। সেখানে ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন তিনি।
মঙ্গলবার স্থানীয় সময় বিকালে টোকিওর হানেদা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাপানী পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তোশিকো আবে সেখানে তাকে অভ্যর্থনা জানান। জাপান পৌঁছেই প্রধানমন্ত্রী প্রবাসী বাংলাদেশিদের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন। পরদিন বুধবার ব্যস্ত দিন কাটবে তার। টোকিওর নিউ ওটানি হোটেলে জাপানের একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলের সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠক হবে। জাপান সফরে ওই হোটেলেই থাকবেন তিনি।
২০১৬ সালে ঢাকার হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় হতাহত জাপানিদের পরিবারের সঙ্গে সেখানে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন শেখ হাসিনা। বুধবার দুপুরে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের কার্যালয়ে হবে দুই দেশের সরকারপ্রধানের দ্বি-পক্ষীয় বৈঠক। শেখ হাসিনা জাপানের প্রধানমন্ত্রীর অফিসে পৌঁছলে সেখানে তাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হবে। দ্বি-পক্ষীয় বৈঠকের পর দুই দেশের মধ্যে আড়াই বিলিয়ন ডলারের একটি ঋণ চুক্তি হতে পারে বলে এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বাংলাদেশে যোগাযোগ, জ¦ালানি ও বিদ্যুৎ খাত এবং শিল্পায়নের জন্য জাপান এ ঋণ সহায়তা দেবে। ৪০তম এই ঋণ প্যাকেজের আকার আগেরবারের চেয়ে ৩৫ শতাংশ বেশি। এই ঋণ দিয়ে মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প, ঢাকা মাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (লাইন ১), বিদেশি বিনিয়োগ সহায়ক প্রকল্প (২), জ¦ালানি দক্ষতা ও সুরক্ষা সহায়ক প্রকল্প (পর্যায়-২) ও মাতারবাড়ি আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে (৫) অর্থায়ন করা হবে।
বুধবার সন্ধ্যায় জাপানি প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে নৈশভোজে অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার তিনি টোকিওতে ‘দ্য ফিউচার অব এশিয়া’ সম্মেলনে বক্তব্য দেবেন। এশিয়ার সম্ভাবনা ও উত্থান নিয়ে নিজের ভাবনা এ সম্মেলনে তুলে ধরবেন শেখ হাসিনা। শিনজো আবে ছাড়াও ‘আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি’ হিসেবে পরিচিত মাহাথির মোহাম্মদ, কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন এবং ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে অংশ নেবেন এ সম্মেলনে।
৩০ ও ৩১ মে এই সম্মেলনে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদ এবং শীর্ষস্থানীয় অধ্যাপক, গবেষক ও তাত্ত্বিকরা আঞ্চলিক বিভিন্ন বিষয় ও বিশ্বে এশিয়ার ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করবেন।
সৌদি সফর: টোকিও থেকে ৩১ মে সকালে বাংলাদেশ বিমানের একটি ভিভিআইপি ফ্লাইটে সৌদি আরবের জেদ্দার উদ্দ্যেশ্যে রওনা হবেন শেখ হাসিনা। ওইদিন বিকেলে জেদ্দা পৌঁছে সেখান থেকে যাবেন মক্কার সাফা প্যালেসে। সেখানে ওআইসির ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলনের চতুর্দশ অধিবেশনে তিনি যোগ দেবেন। রাত পৌনে ১১টা থেকে সেহরির আগে সমাপনী পর্যন্ত সম্মেলনের বিভিন্ন পর্বে যোগ দেবেন তিনি। পরদিন ১ জুন মক্কায় ওমরাহ পালন করবেন প্রধানমন্ত্রী। ২ জুন সকালে আকাশপথে যাবেন মদিনায়। সেখানে তিনি মহানবীর (সঃ) রওজা জিয়ারত করবেন এবং মসজিদে নববীতে নামাজ আদায় করবেন। সেদিন সন্ধ্যায় মদিনা থেকে জেদ্দায় ফিরে ওই রাতেই ফ্রাঙ্কফুর্ট হয়ে ফিনল্যান্ডের হেলসিংকির উদ্দেশ্যে রওনা হবেন তিনি।
হেলসিংকি থেকে ৭ জুন সন্ধ্যায় ফিন এয়ারের একটি ফ্লাইটে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর। সেখান থেকে বাংলাদেশ বিমানের একটি ভিভিআইপি ফ্লাইটে ৮ জুন রাতে ঢাকায় পৌঁছাবেন তিনি।
সফরের আগে জাপান টাইমসে নিবন্ধ: শৈশবে জাপানের জন্য নিজের টানের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে এটা তার মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে।
জাপানে রাষ্ট্রীয় সফর শুরুর আগে মঙ্গলবার দেশটির সবচেয়ে পুরনো ও অন্যতম শীর্ষ গণমাধ্যম দ্য জাপান টাইমসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে নিজের অনুভূতির কথা তুলে ধরেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, শৈশব থেকেই জাপান নিয়ে আমার মধ্যে মোহ কাজ করত। আমি জাপানি চিত্রকলা, ক্যালেন্ডার, ডাকটিকেট, পুতুল ইত্যাদি সংগ্রহ করতাম। জাপান সব সময়ই আমার হৃদয়ের কাছে। ওই নিবন্ধে ‘কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে সেবা ও শিল্প খাতনির্ভর প্রবৃদ্ধির পরিক্রমায়’ বাংলাদেশের রূপান্তরের কালে জাপানি বিনিয়োগকারীদের আমন্ত্রণ জানান। ২৮-৩০ মের টোকিও সফরের জন্য মঙ্গলবার সকালে ঢাকা ছাড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর এটাই জাপানে তার প্রথম সফর। এর আগে ২০১৪ সালে তিনি জাপান সফর করেন। এবার তার সফরের আগে জাপানে নতুন সা¤্রাজ্য শুরু হয়েছে। নতুন যুগকে ‘আশা ও ঐকতানের’ যুগ হিসেবে বর্ণনা করে শেখ হাসিনা বলেন, নতুন এই যুগ আমাদের আরও কাছে টানুক, সম্পর্ক গভীরতর করুক এবং আমাদের শিশুদের জন্য নিরাপদ ও সমৃদ্ধ দেশ গড়তে সহায়তা করুক।
‘উন্নয়নের জন্য জাপান-বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব’ শিরোনামে এই নিবন্ধে তিনি ‘বাংলাদেশকে আরেকটি জাপান হিসেবে গড়তে’ তার বাবার আকাক্সক্ষার কথা তুলে ধরেন। জ¦ালানি ও খাদ্য নিরাপত্তা এবং মানুষের উন্নততর জীবনমান নিশ্চিত করতে চলমান বৃহৎ অবকাঠাসো উন্নয়ন কর্মসূচির গুরুত্ব তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশই বিনিয়োগের সবচেয়ে উদার ও উপযোগী পরিবেশের সুযোগ দিচ্ছে। জাপানি বিনিয়োগকারীদের একটিসহ ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা লিখেছেন, পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ও জাপান সব সময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। সম্পর্কের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, আমাদের দুই দেশের পতাকার মধ্যে অনেক সামঞ্জস্য আছে। জাপানি ছাত্ররা খাবারের পয়সা বাঁচিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। জাতির জনকের কথা স্মরণ করে তার কন্যা বলেন, কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কৃষি থেকে শিল্পায়নের পথে রূপান্তরে জাপানকে অনুসরণে তিনি আমাদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে বঙ্গবন্ধুর জাপান সফর ও পরের বছর তার অনুরোধে জাপানের পক্ষ থেকে যমুনা (বঙ্গবন্ধু) সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা পরিচালনার কথা স্মরণ করেন শেখ হাসিনা। তিনি লিখেছেন, ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সফরের সময় দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জাপান রূপসা সেতু নির্মাণ করে দিয়েছিল। এ ছাড়া পদ্মা সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাইও করে দিয়েছিল। সেসময় দুই দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারে দুদেশের মধ্যে সংসদীয় মৈত্রী কমিটি গঠনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ব্যবসায় ও বিনিয়োগ সুবিধা নিয়ে জাপানি উদ্যোক্তা বাড়তি আগ্রহে আমরা খুবই উৎসাহিত। এখন বাংলাদেশে ২৮০ জাপানি কোম্পানি ব্যবসা করছে, যা বিগত দশকের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। জাপারেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জরিপ বলছে, জাপানের অনুমোদিত কোম্পানির বাংলাদেশে ব্যবসায় উন্নতি করছে। প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, আমরা অর্থনীতির সকল খাতে বিদেশি ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের রাস্তা উন্মুক্ত রেখেছি। এবং সেক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিমাণে কোনো বিধিনিষেধ নাই। ২০১৬ সালের জুলাইতে গুলশানে জঙ্গি হামলায় নাগরিকের প্রাণহানির ঘটনায় জাপানের সঙ্গে বন্ধুত্ব পরীক্ষিত হয়েছে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, দুই দেশ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় একসঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ২০১২ সালে দুই দেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের রজতজয়ন্তী উদযাপন করবে।
জাপান এককভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগী। ১৯৭২ সাল থেকে দেশটির কাছ থেকে বাংলাদেশ মোট এক হাজার ১৩০ কোটি ডলারের সহায়তা পেয়েছে। শেখ হাসিনার জাপান সফরের সময় ৪০তম ঋণ সহায়তার আওতায় আড়াইশ কোটি ডলারের একটি ঋণচুক্তি হবে।

এফএন/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ২২:১৩:৫১ ● ৩৯০ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ