কলাপাড়া (পটুয়াখালী) সাগরকন্যা অফিস॥
কলাপাড়ার গোটা উপকূলের সাগর নদীতে চিংড়ির রেণু পোনা আহরনের উৎসব চলছে। সকল নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ফ্রি-স্টাইলে পোনা আহরণের নামে মৎস্য সম্পদসহ জলজপ্রাণী নিধনযজ্ঞ চলছে। প্রভাবশালী মৎস্য ব্যবসায়ীদের একটি সিন্ডকেট একাজে ব্যবহার করছে এক শ্রেণির অসচেতন দরিদ্র মানুষকে। বাগদা ও গলদা রেণু আহরণ করায় এর সঙ্গে সুক্ষ্ম মশারি নেটে আটকে মারা পরছে অন্য প্রজাতির মৎস্যসহ বিভিন্ন জলজপ্রাণি। কখনও কখনও বিচ্ছিন্ন অভিযানে পোনার চালান আটক হলেও বন্ধ হয়নি মৎস্য সম্পদের নিধনযজ্ঞ। ফলে উপকূলীয় সাগরসহ নদী মৎস্যশুণ্য হয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। নষ্ট হচ্ছে জলজ প্রাণির ইকোসিস্টেম। কমছে মাছের প্রজননসহ উৎপাদন।
কলাপাড়ার বিস্তীর্ণ উপকূল, চরাঞ্চল ও নদীতে জোয়ার-ভাটার সন্ধিক্ষণে ফ্রি-স্টাইলে চলছে চিংড়ি পোনা আহরণ। এ রেণু পোনা আহরনকালে অন্য প্রজাতির মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণি সংগ্রহ করা হচ্ছে। চিংড়ি পোনাগুলো সংগ্রহ করে অন্যান্য প্রজাতির প্রাণি ও মাছের পোনা মাটিতে ফেলে দিচ্ছে আহরনকারী। মারা পরছে সব। আর এভাবেই ধ্বংস হচ্ছে অন্য প্রজাতির কোটি কোটি রেণু পোনা, ডিম ও খাদ্যকনা।
আহরন কারীরা জানায়, ফাল্গুন থেকে আশ্বিন মাসে সমুদ্রের জোয়ারের সময় সমুদ্র তীরসহ উপকূলের নদী ও খাল বিভিন্ন প্রজাতির মৎস্য, জীব, অনুজীবে ভরে যায়। ভাটার সময় পোনা আহরনের ঠিক সময়। এসময় বঙ্গোপসাগরের দীর্ঘ তীরজুড়ে, বিভিন্ন নদীর মোহনায় মশারি ও বাঁশ দিয়ে তৈরি তিনকোনা সাইজের জাল দিয়ে আহরণ করা হয় চিংড়ির রেণু পোনা।
রেণু আহরণকারী গঙ্গামতির শাহনারা জানান, জোয়ারের সময় প্রত্যেক টানে ঢেউয়ের সঙ্গে তার মশারি জালে প্রায় ১৫০/২০০টি চিংড়ির রেণু পোনা আটকা পড়ে। একেকটি পোনা ৫০/৬০ পয়সা দরে আড়তে বিক্রি করেন। একেকজনে প্রতিদিন কমপক্ষে তিন/চার শ’ পোনা আহরণ করেন। এরা আড়তে বিক্রি করলে আড়ত থেকে চালান হয় ঘের মালিকের কাছে।
জানা গেছে, আড়ত মালিকরা দরিদ্র, অসচেতন আহরনকারীদের জালসহ বিভিন্ন উপকরণসহ নগদ টাকা দাদন দেয়। প্রত্যেকটি পোনা আড়াই থেকে তিন টাকায় আড়ত মালিকরা মোকামে বিক্রি করেন। মোটা অংকের ব্যবসার জন্য বিভিন্ন খাতে মাসোহারা দিয়ে নদী ও সড়ক পথে এ পোনা মোকামে চালান হয়। লাভ বেশি থাকায় এ ব্যবসা চলছে অনেক প্রতিকূল পন্থায়। স্থানীয় বিভিন্ন বাজারের আড়ত থেকে সপ্তাহে দুই-থেকে তিনটি চালান ২৫-৩০ হাজার করে পোনা মোকামে চালান হয়। সেখান থেকে ঘেরে পৌছে যায়।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, একটি বাগদা বা গলদা চিংড়ির রেণু পোনা (পিএল-পোস্ট লাম্বা) সংগ্রহ করতে গিয়ে অন্য প্রজাতির ৯৬টি মাছের পোনাসহ খাদ্যকনা জুপ্লাঙ্কটন ও ফাইটো প্লাঙ্কটন ধ্বংস হয়ে যায়। মৎস্য সম্পদের এ ক্ষতির দিকটি পোনা শিকারি, ঘের মালিক ও ব্যবসায়ীরা বিবেচনায় আনছে না। ফলে মৎস্য সম্পদের মারাত্মক ক্ষতি বিবেচনা করে ২০০০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে উপকূলীয় এলাকায় প্রাকৃতিক উৎস থেকে বাগদা, গলদা, সব ধরনের চিংড়িসহ অন্যান্য মাছের পোনা আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
কুয়াকাটা-অলীপুর মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান আনছার উদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘প্রকৃতিগতভাবে এসব পোনা দ্রুত বর্ধনশীল এবং টিকে থাকার উপযোগী হওয়ায় একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এসব পোনা দরিদ্র মানুষকে দাদন এবং জাল দিয়ে ধরতে উৎসাহিত করছে। উপকুলীয় এলাকায় ৫/৭ হাজার নারী-পুরুষ পোনা আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। এসব দরিদ্র মানুষকে পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে এ পেশা থেকে ফেরানোর পরামর্শ তার।
কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মনোজ কুমার সাহা জানান, রেনু পোনা নিধন বন্ধে নিয়মিত অভিযান চলমান রয়েছে। লোকবলসহ পরিবহন সংকটের কারনে অভিযানে কখনও কখনও সমস্যা হচ্ছে। এছাড়াও সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিসারিজ প্রজেক্টের আওতায় রেনু পোনা আহরনকারীদের বিকল্প জীবিকায়নের লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে নিরুৎসাহিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এমইউএম/এমআর