ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
আসন্ন অর্থবছরে করের হার না বাড়িয়ে করদাতার সংখ্যা বাড়ানোর দিকেই বিশেষ নজর দিবে সরকার। সেজন্য নতুন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে করের আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বিশেষ করে ব্যক্তি শ্রেণীর করদাতার সংখ্যা বাড়িয়ে ১ কোটিতে উন্নীত করার ব্যাপক পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। ওই লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর আদায়যোগ্য মানুষ খুঁজে বের করতে সারাদেশে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করবে। সেজন্য নিয়োগ দেয়া হবে ১০ হাজার জনবল। শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকা শহর থেকেই ৪০ লাখ নতুন করদাতা খুঁজে বের করা যাবে বলে এনবিআর সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী। পাশাপাশি কর আদায় বাড়াতে জেলা-উপজেলায়ও কর অফিস স্থাপন করা হবে। এনবিআর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট খাতকে রাজস্ব আদায়ে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আর ভ্যাটের পরই রয়েছে আয়কর খাত। এনবিআরের এবারের মোট রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। তার মধ্যে ভ্যাট থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। আর আয়কর থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে এক লাখ দুই হাজার ২০১ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ওই খাতকে আরো প্রাধান্য দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে করদাতার সংখ্যা বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তাই আগামী অর্থবছরের মধ্যে এক কোটি মানুষকে করের আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। আর পরিকল্পনা মতে, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে আয়কর আদায় বাড়ানো হবে। সেজন্য সম্পূর্ণ অস্থায়ী ভিত্তিতে ১০ হাজার জনবল নিয়োগ দেয়া হবে। নিয়োগ পাওয়া ওই জনবলের প্রায় সবাই হবে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী। তাদের প্রধান কাজ হবে আয়কর আদায়যোগ্য মানুষ খুঁজে বের করা। অনেকটা খানা জরিপের মতো তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবারভিত্তিক সদস্যদের আয়ের উপাত্ত সংগ্রহ করবে। পরে এই উপাত্তগুলো আয়কর অফিসে জমা দেয়া হবে। তার ওপর ভিত্তি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আয়কর আদায়যোগ্যদের আয়করের আওতায় নিয়ে আসবে। নতুন জরিপের মাধ্যমে শুধুমাত্র ঢাকা শহর থেকে ৩০ থেকে ৪০ লাখ নতুন আয়কর দাতা খুঁজে বের করা হবে। তার বাইরে বিভাগীয় শহর, জেলা ও উপজেলা থেকে আরো ৬০ লাখ সম্ভাব্য করদাতার খোঁজ সংগ্রহ করা হবে। সেজন্য কিছুসংখ্যক জেলা-উপজেলায় অফিস স্থাপন করা হবে। পরে পুরো দেশে ওসব অফিস স্থাপন করা হবে। ওসব অফিস থেকেই আয়কর আদায় ও আয়করযোগ্যদের খুঁজে বের করার কাজ পরিচালিত হবে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে ৩৬ লাখের কাছাকাছি নিবন্ধিত করদাতা রয়েছে। যা মোট জনসংখ্যার এক শতাংশেরও কম। বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে দেশে আয়কর দেয়ার যোগ্য মানুষের সংখ্যা রয়েছে ১ কোটিরও বেশি। ওই বিপুলসংখ্যক মানুষকে আয়করের আওতায় নিয়ে আসা হলে নিয়মিত করদাতাদের ওপর বাড়তি চাপ কমবে। পাশাপাশি আয়কর দেয়ার যোগ্য মানুষকে করের আওতায় আনতে না পারলে পুরনো করদাতারা কর দেয়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। ফলে তারা কর ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করবে। আবার নতুন যারা কর দেয়ার সামর্থ অর্জন করেছেন তারাও ভয়ে এর আওতায় আসতে চাইবে না। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকেও আগামী বাজেটে কর আদায় ব্যবস্থা সহজীকরণ ও আওতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, চলতি অর্থবছরে কর্পোরেট কর আড়াই শতাংশ কমানো হয়েছে। আগামী অর্থবছরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকা বহির্ভূত কর্পোরেট কর আড়াই থেকে ৫ শতাংশ কমানোর জন্য ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। তবে জানা যায় আগামী বাজেটে কর্পোরেট কর অপরিবর্তিতই থাকছে। পাশাপাশি বর্তমানে ব্যক্তি শ্রেণীর আয়কর সীমা ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি বছরে ওই পরিমাণ অর্থ আয় করলে তাকে আয়কর দিতে হয় না। গত চার বছর ধরে ব্যক্তি আয়কর সীমা একই রয়েছে। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে তা ৩ লাখ টাকা উন্নীত করার প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। তাছাড়া বিদ্যমান কর ব্যবস্থায় নারী করদাতারা এবং ৬৫ বছরের বেশি বয়সের ব্যক্তিদের করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ টাকা, প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়কর সীমা ৪ লাখ টাকা এবং গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের করমুক্ত আয়কর সীমা ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা রয়েছে। সেক্ষেত্রে করমুক্ত আয়কর সীমা উল্লিখিত ৩টি ধাপ বাড়িয়ে যথাক্রমে সাড়ে ৩ লাখ, ৪ লাখ এবং ৫ লাখ টাকায় উন্নীত করার কথা বলা হয়েছে। তবে জানা যায় এবার ব্যক্তি আয়কর সীমা বাড়তে পারে। আগামী ১৩ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপন করা হবে। এবারের বাজেটের সম্ভাব্য আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা। সেটি বর্তমান সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেট। একই সঙ্গে নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রথম বাজেট।
এদিকে এ প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া জানান, এবারের বাজেট হবে সবচেয়ে বড় বাজেট। বাজেটের খরচের ৬৫ শতাংশ রাজস্ব আহরণ করা হবে। সেটা উচ্চাবিলাসী বলা হলেও বাস্তবায়ন করতে চেষ্টা করা হচ্ছে। আর আগামী অর্থবছর অবশ্যই ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করা হবে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়েছে। ফলে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে কোন সমস্যা হবে না। এখন বাজেটের আওতা বাড়ানোই বড় চ্যালেঞ্জ। ওই চ্যালেঞ্জ নিতে এনবিআর প্রস্তুত। করের আওতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের কোন ক্ষতি হবে না। তবে দেশীয় শিল্পের সহযোগিতার জন্য বর্তমানে যে সুযোগ সুবিধা চালু আছে তা অব্যাহত রাখা হবে।
অন্যদিকে অতিসম্প্রতি সাবেক গবর্নরদের সঙ্গে এক বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের জানান, দেশে ৪ কোটি মানুষ আয়কর দেয়ার উপযুক্ত। কিন্তু কর দিচ্ছে না। তাদের যদি আস্তে আস্তে কর নেটের আওতায় নিয়ে আসা যায় তাহলে রাজস্ব আহরণ অনেক বাড়বে। আগামী এক বছরে এক কোটি মানুষকে করের আওতায় নিয়ে আসা সরকারের লক্ষ্য। আগামী বাজেটে করযোগ্য সবাইকে করের আওতায় নিয়ে আসা হবে। করের হার কমিয়ে আওতা বাড়ানো হবে। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ কর দেয়, এই অভিযোগ আর থাকবে না। তাছাড়া আগামী অর্থবছরে ৩ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা কর আহরণ করা হবে। এবার বাজেটে ভ্যাট, ট্যাক্স ও কাস্টমসেও সংস্কার আনা হবে।
এফএন/এমআর