ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী জমা দেয়া বাধ্যতামূলক হলেও দীঘদিন ধরেই অনেক আমলাই তা পালন করে না। সম্পদের হিসাব না দেয়া আমলাদের মতে, বিদ্যমান ওই বিধিমালা সেকেলে এবং বর্তমানে তা প্রতিপালনযোগ্য নয়। কারণ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখন আয়কর রিটার্ন জমা দেন এবং প্রত্যেকের ব্যক্তিগত টিন নাম্বার রয়েছে। তবে কোনো কোনো আমলার মতে, বিদ্যমান সম্পদ বিবরণী জমা দেয়ার বিধান প্রতিপালনযোগ্য। কারণ বিধানটি রাষ্ট্রপতির আদেশে জারি হয়েছে। সেটা বাতিল করার আগ পর্যন্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করা বাধ্যতামূলক। তাছাড়া আয়কর রিটার্নে কর্মকর্তাদের পুরো সম্পত্তির হিসাব পাওয়া যায় না। এমন অবস্থায় এবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। সকল আমলাকেই সম্পদের হিসাব দিতে হবে। মূলত দুর্নীতির লাগাম টানতে নির্ধারিত ছকে আমলাদের সম্পদ বিবরণী নেয়া হবে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীরও বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী সরকারের কাছে প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদ বিবরণী দাখিল করা বাধ্যতামূলক। তবে এতদিন তা বাস্তবায়ন হয়নি। বিদ্যমান সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিতে প্রবেশের সময় তার ও তার পরিবারের সদস্যদের দখলে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির ঘোষণা দিতে হয়। তারপর প্রতি ৫ বছরে একবার সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধি উল্লেখ করে সরকারের কাছে দাখিল করা বাধ্যতামূলক। সব গণকর্মচারীর জন্য একই বিধান প্রযোজ্য। তবে ক্যাডার বা প্রথম শ্রেণী ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা তাদের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে, দ্বিতীয় শ্রেণীর গেজেটেড বা নন-গেজেটেড কর্মকর্তা এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের নিজ নিজ নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে সম্পদের হিসাব বিবরণী নির্ধারিত সময়ে দাখিল করতে হবে।
সূত্র জানায়, বিগত ২০০৮ সালে সর্বশেষ সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের হিসাব নেয়া হয়। কিন্তু ওই হিসাব বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বস্তাবন্দি হয়ে পড়ে আছে। সেগুলো পর্যালোচনা করে কার সম্পদ বেড়েছে বা কমেছে তা বলা হয়নি। তারপর ২০১৫ সালে শুধুমাত্র ভূমি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নেয়া হলেও তা পর্যালোচনা করে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এবার নির্ধারিত ছকে সব সরকারি কর্মচারীর সম্পদের হিসাব নেয়ার প্রস্তুতি চলছে। সম্পদ বিবরণীর ওই ছকে স্থাবর ও অস্থাবর দুই ধরনের সম্পদের তথ্য চাওয়া হয়েছে। স্থাবর সম্পদের মধ্যে কৃষি ও অকৃষি জমি, ইমারত, বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রাখা হয়েছে। আর অস্থাবর সম্পদের মধ্যে অলঙ্কার, স্টকস, শেয়ার, বীমা, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, মোটর গাড়ি, কম্পিউটার, টেলিভিশন, এয়ারকুলার, রেফ্রিজারেটর, ওভেনসহ ব্যবহার্য সম্পদের বিবরণ থাকবে।
সূত্র আরো জানায়, বিগত ১৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় দুর্নীতি বন্ধে সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করা হয়েছে, তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হবে। তাছাড়া ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেয়ার দিনেই ভূমি ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেন। তিনি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জনস্বার্থে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার নির্দেশ দেন। তবে কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব নিতে গিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। কারণ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ভূমি মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ক্যাডারভুক্ত সব কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে সহকারী সচিব থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত সবাই। তাদের সম্পদের হিসাব নেয়া-না নেয়ার বিষয়টি ওই মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত। তাই ভূমি মন্ত্রণালয় তাদের সম্পদের হিসাব নিতে পারছে না। ওই পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রশাসন সচিব ফয়েজ আহম্মেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নেয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়। আর ওই বিষয়ে কাজ করার জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়।
এদিকে সরকারের একাধিক শীর্ষ কর্তার মতে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখন প্রতি বছরই সম্পদের আয়কর রিটার্ন জমা দিচ্ছে। ফলে মন্ত্রণালয়ে সম্পদের হিসাব জমা দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। যেসব দপ্তরে বেশি অর্থের লেনদেন হয় সেগুলো নজরদারিতে রাখলেই যথেষ্ট। তাছাড়া বড় বড় দুর্নীতি ওপরের দিকেই হয়ে থাকে। নিচের দিকে দুর্নীতি হলেও তা উচ্চ পর্যায়ের তুলনায় বেশ নগণ্য। ফলে শীর্ষ পর্যায়ের আমলাদের নজরে রাখলেই দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব নেয়ার উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে অবশ্যই ভালো হবে। জনপ্রশাসন থেকে তা বাস্তবায়ন করা হলে আরো ভালো হবে। তাছাড়া সেটি সরকারের জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের একটি অঙ্গীকার। ফলে ওই ঘোষিত নীতিমালা অমান্য করার কোনো সুযোগ নেই। তা অনেক আগেই বাস্তবায়ন করা উচিত ছিল। কারণ সরকারি কর্মকর্তারা জনগণের টাকায় বেতন পায় এবং জনগণের জন্যই কাজ করে। ফলে সম্পদের হিসাব দেয়ার অনীহা কোনো ভালো দৃষ্টান্ত নয়। জনস্বার্থে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব জমা দেয়া প্রয়োজন। আর সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালায়ও সম্পদের হিসাব নেয়ার বিধান রয়েছে। ৫ বছর পরপর সম্পদের হিসাব দিতে তারা বাধ্য। কিন্তু এমন ধরনের বিধান থাকলেও তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। বিধানটি বাস্তবায়ন করা জরুরি। শুধু সম্পদের হিসাব নিলেই চলবে না, হিসাব বিবরণী পর্যালোচনা করে ব্যবস্থাও নেয়া দরকার।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানান, সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকে সম্পদের হিসাব দেন, আবার অনেকে দেন না। এবার প্রত্যেকের সম্পদের হিসাব নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জনপ্রশাসন সচিব এ নিয়ে কাজ করছেন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখন প্রতি বছর আয়কর রিটার্ন জমা দেয়। সেজন্য নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের (সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ের) সচিবের কাছে তাদের সম্পদের বিবরণী জমা দিচ্ছে না। তবে আয়কর রিটার্নে কর্মকর্তাদের পুরো সম্পদের হিসাব পাওয়া যায় না। আবার কোনো কর্মকর্তা স্বেচ্ছায় পুরো সম্পদের হিসাব জমা না দিলে ব্যবস্থা নেয়ারও কোনো সুযোগ নেই। সব দিক বিবেচনা করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীন কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব শিগগির নেয়া হবে।
এফএন/এমআর