ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
জাল নোট কারবারীরা রোজা ও ঈদ ঘিরে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। নতুন টাকা বাজারে এলেই জাল নোটের কারবারিদের অপতৎপরতা বেড়ে যায়। তারা বিভিন্নভাবে বাজারে জাল নোট ছড়িয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির মধ্যেও সক্রিয় থাকে জাল নোটের কারবারিরা। তার কারণ মূলত বিভিন্ন সময় ধরা পড়লেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আইনের ফাঁকফোকরে তারা বেরিয়ে যেতে পারে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি বছর ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার আগে বিভিন্ন মূল্যমানের নতুন টাকার নোট বাজারে ছাড়ে। এবারও ঈদে ১৭ হাজার কোটি টাকার নোট বাজারে ছাড়ার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এ সুযোগে মাঠে নেমে পড়েছে জাল নোটের কারবারীরা। কিন্তু সরকার তাদের নিয়ন্ত্রণে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশ রোজা ও ঈদ ঘিরে ইতিমধ্যে টাকার জাল নোটের কারবারিরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। চলতি মাসেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে প্রায় ৫০ লাখ টাকা মূল্যমানের জাল নোট ধরা পড়েছে। তাছাড়া গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে শুধুমাত্র ব্যাংকিং চ্যানেলে ধরা পড়েছে ৪ হাজারের বেশি জাল নোট, যার মূল্যমান ৩৪ লাখ টাকার বেশি। এক হাজার টাকার নোটই সবচেয়ে বেশি জাল হচ্ছে। তবে জাল নোট প্রতিরোধে ইতিমধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সূত্র জানায়, ঈদ ঘিরে শপিং মল ও বিপণিবিতানে জাল নোট শনাক্তকরণ মেশিন সরবরাহ নিয়ে গত এপ্রিলের শুরুতেই পুলিশ সদর দপ্তরে বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় মেশিন সরবরাহের পাশাপাশি ঈদ বাজারে জাল নোটের বিস্তার রোধে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তার মধ্যে অন্যতম হলো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি ও অভিযান বাড়ানো। ওই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সম্প্রতি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বহিনীকে চিঠি দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সেই নির্দেশনা অনুযায়ী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদ্যোগে জাল নোট নিয়ন্ত্রণে সারা দেশে অভিযান শুরু হয়েছে। গত ১০ মে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) রাজধানীর কামরাঙ্গীর চর থানার পূর্ব রসুলপুর এলাকা থেকে জাল নোট প্রস্তুতকারী ৩ জনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ৪৬ লাখ টাকা মূল্যমানের জাল নোট। গ্রেফতারকৃতরা স্বীকার করেছে যে তারা রোজা ও ঈদ ঘিরে বাজারে জাল নোট ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল। তাছাড়া গত ১৩ মে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রায় আড়াই লাখ টাকা মূল্যমানের জাল নোটসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি।
সূত্র আরো জানায়, আসন্ন ঈদ ঘিরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সব শাখা কার্যালয় এবং ৩০টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ২৮টি শাখায় নতুন নোট বিনিময়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আগামী ২২ মে থেকে ৩০ মে পর্যন্ত নতুন নোট বিনিময়ের এ কার্যক্রম চলবে। তাছাড়া ঈদের আগে মানুষের কেনাকাটা বাড়ে বলে ব্যাংক থেকে নগদ টাকা উত্তোলনের পরিমাণও বাড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে বিভিন্ন মূল্যমানের ৪ হাজার ৩১৯টি জাল নোট ধরা পড়েছে। যার মূল্যমান ৩৪ লাখ ৩২ হাজার ৮০০ টাকা। তার মধ্যে ৩ হাজার ২৯টিই এক হাজার টাকা মূল্যমানের নোট। আর ৫০০ টাকা মূল্যমানের ৬৮৭টি এবং ১০০ টাকা মূল্যমানের ৫০৩টি নোট রয়েছে। আর চলতি বছরের প্রথম ৩ মাসে জাল নোটের মামলা হয়েছে ৪৯টি। তার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ১৮টি। নিষ্পত্তির হার ৩৬ শতাংশ। গত বছর ১৮৮টি মামলার মধ্যে নিস্পত্তি হয়েছে মাত্র ৫০টি। নিষ্পত্তির হার প্রায় ২৬ শতাংশ। তার আগে ২০১৭ সালে ২৮৭টি, ২০১৬ সালে ৩৪৪টি, ২০১৫ সালে ৪১০টি এবং ২০১৪ সালে ৩৬৮টি মামলা হয়। সব মিলিয়ে ২০১৯ সালের মার্চ শেষে জাল নোটের অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৭০৪টি। মূলত সাক্ষীর অভাবে জাল নোট মামলার ৬০ শতাংশ আসামি খালাস পেয়ে যায়।
এদিকে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(ক) উপধারায় জাল নোট কারবারের সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান ছিল। তবে ১৯৮৭ সালে এরশাদ শাসনামলে ওই বিধান রহিত করে যাবজ্জীবন কারাদ- করা হয়। কিন্তু ওই আইনে বিচার কার্যক্রম পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে বিচারকালে শুনানির নির্ধারিত দিনে প্রায় সময়ই সাক্ষী উপস্থিত না থাকায় মামলার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ওসব দিক বিবেচনায় নিয়ে পৃথক একটি আইন প্রণয়নের জন্য ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর জাল নোট প্রচলন প্রতিরোধ সংক্রান্ত কমিটির সভায় ৬ সদস্যের একটি উপ-কমিটি করা হয়েছিল। ওই উপ-কমিটি আইনের খসড়া প্রণয়ন ও চূড়ান্ত করে ইতিমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই সংক্রান্ত কোনো অগ্রগতি জানা যায়নি। তবে নতুন আইনটি পাস হলে সেটি হবে দেশে জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে প্রথম আইন। আরআইনটি বাস্তবায়নে জাতীয় এবং জেলা পর্যায়ে কমিটি থাকবে। কমিটির সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে আইনের আওতায় গঠন করা হবে জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সেল। তাছাড়া নতুন আইনে জাল নোট সংক্রান্ত খবর দেয়া হলে সংবাদদাতাকে পুরস্কার দেয়ারও বিধান থাকছে। জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ আইনের খসড়ায় অপরাধীদের জন্য পর পর তিন দফা শাস্তি আরোপের বিধান রাখা হয়েছে। প্রথমবার অপরাধ করে শাস্তি ভোগ করে দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে শাস্তি হবে প্রথমবারের তুলনায় দ্বিগুণ। একই ব্যক্তি আবার এমন অপরাধ তৃতীয়বার করলে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন সাজা হবে।
অন্যদিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জাল টাকা দেশের অর্থনীতির জন্য শুভ নয়। তা প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে জাল নোটের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া জরুরি। জাল নোটের কারবারিদের শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে জাল নোট ছড়ানোর প্রবণতা বাড়তে থাকে। সেজন্য জাল নোটের মামলাগুলো সংবেদনশীল হিসেবে দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। পাশাপাশি জাল নোটের মামলা থেকে আসামিরা যাতে জামিন নিয়ে বের হতে না পারে, সেদিকটিও নিশ্চিত হওয়া দরকার।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, বিভিন্ন উৎসবের আগে নোট জালকারী চক্রের অপতৎপরতা বৃদ্ধি পায়। তাদের অপতৎপরতা প্রতিরোধে আসল ব্যাংক নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যসংবলিত ভিডিও চিত্র রমজান মাসজুড়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ জনসমাগমস্থলে ও রাস্তার মোড়ে কমপক্ষে এক ঘণ্টা করে প্রচারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাছাড়া গ্রাহকদের কাছ থেকে নোট গ্রহণ ও প্রদানকালে এবং এটিএমে টাকা ফিডিংয়ের আগে আবশ্যিকভাবে জাল নোট শনাক্তকারী মেশিন দ্বারা নোট পরীক্ষা করার কথাও বলা হয়েছে।
এফএন/এমআর