ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
সরকার দেশের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে তরল প্রাকৃতি গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করছে। কিন্তু বছরে চুরি হয়ে যাচ্ছে কয়েক হাজার কোটি টাকার গ্যাস। কোনোভাবেই ওই গ্যাস চুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না। বরং দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চুরি বন্ধ না করে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না। বরং তা হবে একটি ভুল সিদ্ধান্ত। মূলত গ্যাস চুরি বন্ধ ও সিস্টেম লস কমাতে পারলেই জ্বালানি ঘাটতির একটি বড় অংশ পূরণ করা সম্ভব হবে। বর্তমানে দুটি বেসরকারি কোম্পানি দৈনিক ৫৩ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করছে। যদিও ওই দুই কোম্পানি প্রতিদিন মাত্র ১শ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু পাইপলাইনে সমস্যা থাকার কারণে পেট্রোবাংলা ওই গ্যাস বিতরণ করতে পারছে না। জ্বালানি বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে বিদ্যমান দামের চেয়ে প্রায় ৫ গুণ বেশি দামে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। ফলে সরকারকে ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে। বর্তমানে যে পরিমাণ এলএনজি আমদানি হচ্ছে তাতে বছরে ঘাটতি দাঁড়াবে ২৪ হাজার কোটি টাকা। আর বছরে কমবেশি ৭ হাজার কোটি টাকার গ্যাস চুরি হচ্ছে। জনগণের টাকায় অতি উচ্চমূল্যে আমদানি করা গ্যাস কোনোভাবেই চোরদের কাছে বিকিয়ে দেয়া উচিত হবে না বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। সেজন্য প্রথমেই তিতাসের দুর্নীতিবাজ কর্মীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। কারণ তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে গ্যাস চুরি করা সম্ভব নয়। আর দেশে ভবিষ্যতে গ্যাস আমদানি আরো বাড়বে। প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। শিল্পকারখানা বাড়ছে। ফলে চুরি বন্ধ করতে না পারলে এই আমদানি করে পুরোপুরি সুফল পাওয়া যাবে না। আর গ্যাসের অবৈধ ব্যবহার বন্ধে প্রায়ই অভিযান পরিচালনা করা হলেও তা ফলপ্রসূ হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, রাজধানীসহ সারাদেশেই গ্যাস চুরি বাড়ছে। তবে ঢাকা, নারায়াণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ ও কুমিল্লায় বেশি গ্যাস চুরি হচ্ছে। দৈনিক প্রায় ২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস চুরি হয়। তবে রাজধানীর আশপাশের অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দৈনিক অন্তত ১৫ কোটি গ্যাস চুরি রোধ করা সম্ভব। শুধুমাত্র অবৈধ সংযোগের কারণে বছরে ১২শ’ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি নিয়ে একটি প্রতিবেদন জ্বালানি বিভাগে জমা দিয়েছে। তাতে গ্যাস চুরির বিষয়টি বিশদভাবে উঠে এসেছে। দুদকের প্রতিবেদনে অবৈধ সংযোগকে তিতাসের দুর্নীতির প্রধান খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবৈধ সংযোগের কারণে সংস্থাটির ৬ শতাংশ সিস্টেম লস হয়। বিভিন্ন কারখানা ও বাসাবাড়িতে চোরাই সংযোগ প্রদান ও লোড বাড়ানোর মাধ্যমে তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অর্থ আত্মসাৎ করে। আর আবাসিকের চেয়ে শিল্পে গ্যাস চুরির হার বেশি। সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সংযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের অডিট প্রতিবেদন অনুসারে একটি অবৈধ সংযোগের জন্য তিতাসের কর্মচারীকে ৪৫ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। দুদকের মতে, অর্থের বিনিময়ে ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতে বয়লার ও জেনারেটরে অনুমোদনের অতিরিক্ত লোডে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। মিটার বাইপাস করে গ্যাস সরবরাহ এবং ঘুষের বিনিময়ে মিটার টেম্পারিং করে গ্রাহকের প্রকৃত বিল গোপন করে দুর্নীতি করা হয়। তাছাড়া ব্যয় কম হওয়ায় হোটেল রেস্টুরেন্ট বেকারি, সুপারশপ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্যিক গ্রাহকের পরিবর্তে শিল্প গ্রাহক হিসেবে সংযোগ দেয়া হয়। দুদক বলছে, শিল্পকারখানায় অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে গ্যাস দিয়ে তা বাসাবাড়িতে সিস্টেম লস হিসেবে দেখানো হয়।
সূত্র আরো জানায়, কম চাপে গ্যাস দেয়া ও সিস্টেম লস দেখানোর মাধ্যমে আবাসিক খাতে বছরে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে। শুধুমাত্র গ্যাস চুরিই নয়, অবৈধ গ্রাহকের কাছ থেকে ভুয়া বিল আদায়ের ঘটনাও ঘটছে। দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিনজিরা, ফতুল্লা, সোনারগাঁ, নরসিংদী ও গাজীপুর এলাকায় এক লাখ ১৮ হাজার ৪৫৫টি অবৈধ সংযোগ চিহ্নিত করা হয়। ওসব সংযোগের বিপরীতে বৈধ চুলার মতো মাসিক ৬৫০ টাকা হারে বিল আদায় করা হয়। ওভাবে মাসে ৯২ কোটি ৪০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। তিতাসের কিছু অসাধু কর্মচারী সিন্ডিকেট করে বিল ভাউচারে ভুয়া সংকেত দিয়ে অবৈধ গ্রাহকের কাছ থেকে বিল আদায় করে। ভুয়া সংকেত দেয়া বিলগুলো তিতাসের ব্যাংক হিসাবে পেস্টিং এবং লেজারে তোলা হয় না। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের অডিটে শুধু আবাসিকে ১৬ কোটি ৭১ লাখ টাকার ভুয়া ভাউচারের তথ্য দেয়া হয়েছে।
এদিকে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর ভিজিল্যান্স টিম মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও কয়েকদিনের মধ্যে আবার সেসব সংযোগ চালু হওয়ার ঘটনা ঘটছে। অভিযোগ রয়েছে, সংশ্নিষ্ট এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তত্ত্বাবধানে বিতরণ কোম্পানির গ্যাসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বছরের পর বছর চলছে ওই গ্যাস চুরি। তাাতে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। দুদকের প্রতিবেদনে প্রভাবশালী মহলের চাপকে অবৈধ হস্তক্ষেপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর পেট্রোবাংলার তথ্য মতে, গত পাঁচ বছরে রাজধানী ও আশপাশের জেলাগুলোতে ৫ লাখ চুলায় অবৈধ সংযোগ নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে তিতাস ২ লাখ অবৈধ চুলার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। সংশ্নিষ্ট থানায় এ-সংক্রান্ত দেড়শ’ সাধারণ ডায়েরি (জিডি) এবং একশ’র মতো মামলা হয়েছে। আর তিতাসের তথ্য মতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কারচুপি, অবৈধ সংযোগ, অনুমোদন অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহারের কারণে প্রায় ৭০ হাজার অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। তার মধ্যে প্রায় ৫০০ শিল্প, ক্যাপটিভ এবং বাণিজ্যিক সংযোগ। অবশিষ্ট ৬৯ হাজার আবাসিক সংযোগ ছিল।
অন্যদিকে ভিজিল্যান্স টিমের অভিযানে ফল না আসায় সরকার গ্যাস চুরির বিরুদ্ধে আরো জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মাঠপর্যায়ে অভিযানে প্রভাবশালীদের বাধা পেরোতে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের সমন্বয়ে কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ইতিপূর্বে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ঢাকা বিভাগের ১২ সংসদ সদস্যকে এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে, সবার জন্য টেকসই জ্বালানি নিশ্চিত করতে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। দেশে সবচেয়ে বড় বিতরণ কোম্পানি তিতাস। এই কোম্পানির বিতরণ লাইনে অনেক ক্ষেত্রেই অবৈধ সংযোগ রয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে তিতাসের আওতাধীন এলাকাকে অবৈধ সংযোগমুক্ত করতে চায় সরকার। কারণ অবৈধ সংযোগের কারণে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং শিল্প কারখানায় নতুন সংযোগ দেওয়া যাচ্ছে না। এজন্য অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ এবং পাইপলাইন অপসারণ কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। এই অভিযান পরিচালনাকালে অনেক এলাকায় স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়।
এ বিষয়ে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, গ্যাস চুরি রোধে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে শিগগিরই মাঠে নামবে জ্বালানি বিভাগ।
এফএন/এমআর