ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
ঘূর্ণিঝড় ফণীর কারণে ঘরবাড়ি, বাঁধ, সড়ক ও কৃষিতে ৫৩৬ কোটি ৬১ লাখ ২০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে।
ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে বৃহস্পতিবার (৯ মে) সচিবালেয়ে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা শেষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব শাহ কামাল এই তথ্য দেন। তিনি জানান, ফণীর কারণে ৭৮ কোটি ১৪ লাখ ২০ হাজার টাকার ঘরবাড়ি, ২৫১ কোটি টাকার বাঁধ, মাছে ২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা, ৫ কোটি টাকার আমের বাগান এবং কৃষিতে ৩৮ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় সরকার বিভাগের ২৪১ কিলোমিটার রাস্তা মেরামতের খরচ হিসাব করে ১৬১ কোটি ৬৩ লাখ টাকার ক্ষতি ধরা হয়েছে বলে জানান ত্রাণ সচিব।
মৌসুমের প্রথম ঘূর্ণিঝড় ফণী গত শুক্রবার ঘণ্টায় প্রায় ২০০ কিলোমিটার গতির ঝোড়ো বাতাস নিয়ে ভারতের ওড়িশা উপকূলে আঘাত হানে। তবে শনিবার বাংলাদেশে ঢোকার সময় এর গতি ৮০ কিলোমিটারে নেমে আসে। ফলে দেশে ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড় ফণীর কারণে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপণসহ পুনর্বাসনের পরিকল্পনা তৈরি করে বৃহস্পতিবারের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
ফণীর তা-বে বরগুনায় ২ জন এবং ভোলা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরে একজন করে মোট পাঁচজন নিহত এবং ৬৩ জন আহত হয়েছেন বলে জানান প্রতিমন্ত্রী। তিনি জানান, ২ হাজার ৩৬৩টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ এবং ১৮ হাজার ৬৭০টি ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ৬৩ হাজার ৬৩ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আর্থিক পরিমাণ ৩৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, বিভিন্ন জেলায় ২১ দশকি ৯৫ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন ২৪১ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ফণীর কারণে ৩৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
এ ছাড়া নেত্রকোণায় হাওরের যে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় তা মেরামত করেছে। অন্যান্য এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতের জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব সভায় ২৫১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করলে অর্থ বিভাগ তা অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানায়। ঘূর্ণিদুর্গত মানুষের জন্য ১৪ হাজার ৫০ মেট্রিকটন চাল, ৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকা, ৪১ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ৪ হাজার বান্ডেল ঢেউটিন এবং গৃহ নির্মাণের জন্য ১ কোটি ২০ লাখ টাকা মঞ্জুর করার কথা সভায় জানায় ত্রাণ মন্ত্রণালয়। প্রতিমন্ত্রী বলেন, লক্ষ্মীপুরে ৩৫টি বিদ্যালয় ঘূর্ণিঝড়ে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। যাচাই-বাছাই করে সেগুলো সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাদের আওতাধীন ২৪১ কিলোমিটার রাস্তা মেরামতের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানিয়েছে সভায়। ঝড়ে যেসব টিউবওয়েল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে মেরামত করতে বলা হয়েছে। এনামুর বলেন, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ প্রস্তুত ছিল, তাদের হেলিকপ্টারে ত্রাণের খাবার প্রস্তুত করা ছিল, প্রয়োজন না হওয়ায় সেগুলো সরবরাহ করা হয়নি। তিন বাহিনীর প্রধান আগামি সপ্তাহে সভা করবেন, দুর্যোগ মোকাবেলায় কীভাবে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখা যায়। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ঋণ মওকুফ এবং পুনরায় ঋণ দেওয়ার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে যেসব চাষী পরিশোধ করতে পারেননি, তাদের বিরুদ্ধে যেন মামলা করা না হয়, সেজন্য অর্থ বিভাগকে বলা হয়েছে। তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে সেই সুপারিশ করবে।
এছাড়া স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আরও জোরদার করার বিষয়েও সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী। সিনিয়র সচিব শাহ কামাল জানান, অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ মোকাবিলায় বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস ও এ ক্ষেত্রে সরকারের প্রস্তুতির কাজ অন্য দেশের জন্য অনুকরণীয় বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় আবহাওয়া অফিস। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের (বিএমডি) পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদকে এক চিঠিতে ধন্যবাদ জানিয়ে অদূর ভবিষ্যতে সহযোগিতার আশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস’। তিনি বলেন, একটি মেসেজ আছে। মেসেজটি হলো, আমেরিকান ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস থেকে আমাদের আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালককে বলেছে, বাংলাদেশ যে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এটা অন্য দেশের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে এবং সব দেশকে এটা জানানোর জন্য কীভাবে আমরা এই ফণী মোকাবিলার কাজ করেছি, এ বিষয়ে তারা মেসেজ দিয়েছে। তারা বলেছে বাংলাদেশ যে এ ধরনের একটি জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়কে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে, এই প্রসেসটা ও কীভাবে আমরা সমন্বিত প্রচেষ্টা নিয়েছি- এটা অন্য দেশের জন্য শিক্ষণীয় ও অনুকরণীয় হতে পারে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান বলেন, আপনারা দেখেছেন দুর্যোগের সময় ফণী সংক্রান্ত তিনি যে তথ্য দিয়েছেন অত্যন্ত সঠিকভাবে দিয়েছেন। ওনার তথ্যের উপর ভিত্তি করে যে কাজ করেছি সেগুলোর সুফল আমরা পেয়েছি। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া সংস্থা থেকে এ ধরনের প্রশংসা এরআগে আবহাওয়া অধিদপ্তর পেয়েছিল বলে আমার জানা নেই, অর্থাৎ এটাই প্রথম। তিনি বলেন, আবহাওয়া অফিসের কর্মীরা দিনরাত কাজ করে যে পূর্বাভাস দিয়েছিল এবং মিডিয়ার মাধ্যমে তা প্রচারিত হয়ে মানুষ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এ বি তাজুল ইসলাম, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম ছাড়াও কয়েকজন সচিব এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন সভায়।
এফএন/এমআর