ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
দেশজুড়ে এবার বোরোর বাম্পার ফলন হলেও দাম নিয়ে কৃষকরা হতাশ। ফণীর প্রভাবে ঝড়বৃষ্টিতে শত শত একর জমির পাকা ধান নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও কৃষকরা ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। ক্রেতা নেই। আর বর্তমানে বাজারে ধানের যে দাম তাতে লাভ তো দূরের কথা কৃষকের ৎ্পাদন খরচই উঠছে না। বরং কৃষককে প্রতি মণ ধানে ন্যূনতম ২০০ টাকা করে লোকসান হচ্ছে। কারণ দেশে সার, সেচ, কৃষি যন্ত্রপাতির দাম বেশি। আর এখন এক মণ ধানের দামে একদিনের জন্য একজন শ্রমিকও পাওয়া যায় না। এমন অবস্থায় কৃষির আধুনিকায়ন ছাড়া বিকল্প নেই বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। কৃষক এবং কৃষি বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চলতি বছর প্রতি কেজি বোরো ধান উৎপাদনে খরচ হয়েছে সাড়ে ২৪ টাকা। আর প্রতি কেজি চালের উৎপাদন খরচ পড়েছে ৩৬ টাকা। ওই হিসেবে প্রতি মণ (কেজির হিসেবে) ধানের উৎপাদন খরচ হয়েছে ৯০৬ টাকা ৫০ পয়সা। অথচ বর্তমানে দেশের হাট-বাজারগুলোতে প্রতি মণ বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে ৫শ থেকে সর্বোচ্চ ৭শ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি মণ ধানে কৃষকের প্রায় ২শ থেকে ৪শ টাকা লোকসান দাঁড়াচ্ছে। ফলে বর্তমান দরে কৃষক তার কষ্টার্জিত ফসল বিক্রি করে স্বচ্ছলতার মুখ দেখা-তো দূরের কথা, জীবিকা চালানোই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অথচ গত এক দশক ধরেই ধানের উৎপাদন ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছেন কৃষক। চলতি বছরের শুরুতে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএ বলেছে, বিশ্বে এ বছর বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন সবচেয়ে বেড়েছে।
সূত্র জানায়, বিগত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে মোট চাল উৎপাদন হয় ৩ কোটি ৪৭ লাখ টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩ কোটি ৩৮ লাখ টন আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৩ কোটি ৬২ লাখ টন। আর এ বছর চালের উৎপাদন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। চলতি অর্থবছরে আউশ, আমন ও বোরো মিলে মোট ৩ কোটি ৬৪ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। তার মধ্যে চলতি অর্থবছরে আউশ মৌসুমে ২৯ লাখ ২০ হাজার টন ও আমনে এক কোটি ৪৩ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংকের মতে, পরপর কয়েক বছর ধানের বাম্পার ফলনের ফলে বাংলাদেশের কৃষিতে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। কিন্তু কৃষকের জীবনমানের কোনো উন্নতি নেই। তাদের ভাগ্য বদলাচ্ছে না। বিগত ১৯৯৬ সালের কৃষিশুমারি অনুযায়ী ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক, মাঝারি ও বড় কৃষকের সংখ্যা যথাক্রমে ৭৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ, ১৭ দশমিক ৬১ ও ২ দশমিক ৫২ শতাংশ। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ করে ফসল ফলান। তারা ফসল ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তা বিক্রি করে দেন। এ সময় যদি ধানের ন্যায্য দাম না পাওয়া যায় তাহলে তারা একদম পথে বসে যায়। মূলত অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের কার্যকর ব্যবস্থাপনা গড়ে না ওঠায় তা কৃষকের কোনো কাজে আসছে না। গত আমন মৌসুমেও ৮ লাখ টন সিদ্ধ চাল সংগ্রহ করেও বাজারে ধানের দামে কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। এ বছর বোরো মৌসুমে ২৬ টাকা কেজি দরে ধান ও ৩৬ টাকা কেজি দরে ১২ লাখ টন চাল কিনবে সরকার। কিন্তু কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি না কেনায় তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হবে না। অথচ ২০০৬ সালের জাতীয় খাদ্য নীতিতেও অতিরিক্ত উৎস হিসেবে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহের নির্দেশনা রয়েছে।
এদিকে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এদেশের জমিগুলো ছোট ছোট। সেজন্য উৎপাদন খরচ বেশি পড়ে। যদি কৃষকরা একত্র হয়ে একসঙ্গে জমি চাষ করে তাহলে উৎপাদন খরচ কমে আসবে। তারা লাভবান হবে। একই সঙ্গে সরকারের অভ্যন্তরীণ ধান-চাল সংগ্রহ পদ্ধতি নিয়ে ভাবতে হবে। তাতে কৃষকের কোনো লাভ হচ্ছে না। বাজারেও কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না। ফণীর আঘাতে ফসলের ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু শস্য বীমা না থাকায় কৃষক কোনো ক্ষতিপূরণ পাবে না। এসব বিষয় নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জানান, সরকার অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে প্রতি বছর যে ধান-চাল সংগ্রহ করে তাতে কিছু পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট, মিলার ও ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছে। তাতে কৃষকের কোনো লাভ নেই। এবারও বোরো মৌসুমে ধানের দাম কম। বিষয়টা নিয়ে সরকার সিরিয়াসলি ভাবছে। এ ব্যাপারে খুব শিগগির কৃষি, খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বসে করণীয় ঠিক করবে। কারণ বর্তমানে দেশে এখন সাড়ে ৩ কোটি টনের বেশি চাল উৎপাদন হয়। সেখানে ১০ লাখ টন চাল সংগ্রহ করলে বাজারে কোনো প্রভাব পড়বে না। প্রয়োজনে উদ্বৃত্ত চাল রফতানি করা হবে। তাহলে কৃষক লাভবান হবে।
এফএন/এমআর