ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে বসানো হল আরও একটি স্প্যান; যার মধ্যে দিয়ে দুই প্রান্ত মিলিয়ে দক্ষিণ জনপদের মানুষের স্বপ্নের এই সেতুর ১০৫০ মিটার অংশ দৃশ্যমান হল।
সেতু বিভাগের প্রকৌশলী মো. হুমায়ুন কবীর জানান, বুধবার (২৩ জানুয়ারি) সকাল ১০টায় পদ্মাসেতুর ৩৬ ও ৩৭ নম্বর পিলারের ওপর ধূসর রঙের স্প্যানটি বসিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু হয়। এ নিয়ে সেতুর জাজিরা প্রান্তের মোট ছয়টি স্প্যান বসানো হল। এর আগে ৩৭ থেকে ৪২ নম্বর পিয়ারে পাঁচটি স্প্যান বসানোর মধ্যে দিয়ে জাজিরা পাড়ের সঙ্গে পদ্মা সেতুর সংযোগ ঘটে। এছাড়া মাওয়ার দিকে সেতুর ৪ ও ৫ নম্বর পিয়ারের ওপর আরেকটি স্প্যান বসিয়ে রাখা হয়েছে গেলবছর। ওই স্প্যানটি তৈরি করা হয়েছে ৬ ও ৭ নম্বর পিয়ারে বসানোর জন্য। কিন্তু নকশা জটিলতায় ওই দুটি পিয়ার তৈরি না হওয়ায় এবং ওয়ার্কশপে জায়গা না থাকায় অস্থায়ীভাবে সেটি ৪ ও ৫ নম্বর পিয়ারে তুলে রাখা হয়। এখন নকশা জটিলতা কেটে যাওয়ায় ৬ ও ৭ নম্বর পিয়ার তৈরি হলে স্প্যানটি সেখানে সরিয়ে নেওয়া হবে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
প্রতিটি ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে মোট ৪১টি স্প্যান ৪২টি পিয়ারের ওপর বসিয়েই তৈরি হবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু। দ্বিতল এই সেতুতে থাকবে রেল চলাচলের ব্যবস্থাও। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুর প্রায় ৭২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে জানিয়ে সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি বছরের মধ্যেই সব স্প্যান বসিয়ে ফেলা যাবে বলে আশা করছেন তারা।
প্রকৌশলী হুমায়ুন কবীর জানান, জাজিরা প্রান্তের ষষ্ঠ স্প্যানটি আরও আগেই বসানোর কথা ছিল। কিন্তু কুমারভোগের ওয়ার্কশপ থেকে প্রায় তিন হাজার টন ওজনের স্প্যানটি নিয়ে বিশাল আকারের ভাসমান ক্রেইনের জাজিরা যাওয়ার মত পানি নদীতে ছিল না। মাঝের চর নামের বিশাল একটি চর কেটে সেতুর জন্য যে চ্যানেল করা হয়েছিল, তার প্রায় পুরোটায় গত বর্ষা মৌসুমে পলি জমে গভীরতা কমে যায়। সে কারণে চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানির তিনটি ড্রেজার এবং স্থানীয় আরও চারটি ড্রেজার দিয়ে গত কিছুদিন পলি সরানো হয়। চ্যানেলে প্রয়োজনীয় গভীরতা ফেরার পর ভাসমান ক্রেইন তিয়ানি হাউ মুন্সীগঞ্জের কুমারভোগের ওয়ার্কশপ থেকে স্প্যানটি নিয়ে মঙ্গলবার জাজিরা পৌঁছায়। বুধবার ওই ক্রেইন দিয়েই স্প্যানটি বসানো হয় পিয়ারের ওপর।
এদিকে নদীর নীচে মাটির গঠনের কারণে মাওয়া প্রান্তের ৬ ও ৭ নম্বর পিলারের নকশা জটিলতা তৈরি হয়েছিল। ফলে নদীর ওই অংশের কাজ অনেকদিন ধরেই থমকে ছিল। প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে যে নতুন নকশা তৈরি করা হয়েছে তা ১৫ জানুয়ারি অনুমোদন পেয়ে যাওয়ায় এখন ৬ ও ৭ নম্বর পিলার বসানোর সমস্যাও মিটে গেছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তবে সামনে বর্ষা মৌসুম থাকায় মাওয়া প্রান্ত আবারও খর¯্রােতা হয়ে উঠবে। তখন সেখানে পিলার বসানোও কঠিন হয়ে যাবে। এ কারণে বর্ষা আসার আগেই মাওয়া প্রান্তের সব পিলারের জন্য পাইলিংয়ের কাজ শেষ করে ফেলতে চাইছে কর্তৃপক্ষ। মূল সেতুটি তৈরি হবে মোট ৪২টি পিলারের ওপর। এর মধ্যে ২০টি ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আরও ১১টি পিলার দৃশ্যমান হবে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
দোতলা এ সেতুর নিচ তলায় চলবে ট্রেন। ইতোমধ্যে পিয়ারে বসানো স্প্যানগুলোতে রেলের স্ল্যাব বসানোর কাজ চলছে। জাজিরা প্রান্তের স্প্যানগুলোকে এ পর্যন্ত ১২৮টি রেলওয়ে স্ল্যাব বসানো হয়েছে। পুরো সেতুতে এরকম ২ হাজার ৯৫৯টি স্ল্যাব বসিয়ে তৈরি হবে রেলপথ। মাওয়ার কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডেই স্প্যান ও স্ল্যাব বানানোর কাজ চলছে। সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি শতকরা ৬৩ ভাগ। মূল সেতুর অগ্রগতি শতকরা ৭৩ ভাগ, নদীশাসন কাজের অগ্রগতি শতকরা ৫০ ভাগ ও মোট ২৬১টি পাইলের মধ্যে ১৯১টি পাইলের কাজ শেষ এবং আরও ১৫টি পাইলের আংশিক কাজ শেষ হয়েছে। মোট পিলার ৪২টি, এর মধ্যে ১৬টির কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হয়েছে। ১৫টি পিলারের কাজ চলমান রয়েছে। এ ছাড়া ১৭টি স্প্যান প্রস্তুত রয়েছে। জানা যায়, মাওয়া প্রান্তে পদ্মাসেতুর ৪ ও ৫ নম্বর পিলারের ওপর একটি স্প্যান রাখা হয়েছে। জাজিরা প্রান্তে বসিয়ে দেওয়া স্প্যানে এ পর্যন্ত ১২৮টি রেলওয়ে স্ল্যাব বসেছে। রেল লাইনের জন্য ২ হাজার ৯৫৯টি স্ল্যাবের মধ্যে ১ হাজার ৩০৫টি স্ল্যাব তৈরি হয়েছে। আর ২২ মিটার দৈর্ঘ্যরে রোডওয়ে স্ল্যাব প্রয়োজন হবে ২ হাজার ৯১৭টি। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের দু’পাড়েই এই রোডওয়ে স্ল্যাব তৈরি হয়েছে ২৮০টি।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বসানো হয় প্রথম স্প্যান। এর প্রায় ৪ মাস পর ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি দ্বিতীয় স্প্যানটি বসে। এর দেড় মাস পর ১১ মার্চ জাজিরা প্রান্তে ধূসর রঙের তৃতীয় স্প্যান বসানো হয়। এর ২ মাস পর ১৩ মে বসে চতুর্থ স্প্যান। এর এক মাস ১৬ দিনের মাথায় পঞ্চম স্প্যানটি বসে ২৯ জুন। আর বুধবার ৬ মাস ২৫ দিনের মাথায় বসলো ষষ্ঠ স্প্যানটি। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুতে ৪২টি পিলারের ওপর বসবে ৪১টি স্প্যান। পদ্মা বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি হবে দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে এ সেতুর কাঠামো।
এফএন/এমআর