ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিচারিক আদালতের দেওয়া দন্ড বাতিল ও খালাস চেয়ে খালেদা জিয়ার করা আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেছে হাই কোর্ট। পাশাপাশি বিচারিক আদালতের রায়ে দেওয়া অর্থদন্ড স্থগিত এবং সম্পত্তি জব্দের আদেশে স্থিতাবস্থা দেওয়া হয়েছে। তবে এই মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনটি শোনেনি আদালত। জামিনের আবেদনটি নথিভূক্ত করে দুই মাসের মধ্যে মামলার নথি তলব করা হয়েছে। নথি পাওয়ার পর জামিনের বিষয়ে বিবেচনা করবে আদালত।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এস এম কুদ্দুছ জামানের হাই কোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) এই আদেশ দেয়। আদালতে খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন। তার সঙ্গে ছিলেন খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, জমিরউদ্দিন ফিরকার, মাহবুব উদ্দিন খোকন ও ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। দুদকের পক্ষে শুনানি করেন খুরশিদ আলম খান। রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
জামিনের বিষয়ে আদালত বলেছে, সাত বছরের সাজার মামলায় আমরা জামিন দেই না, তা না। যেহেতু অন্য একটি মামলায় উচ্চতর আদালত সাজা বাড়িয়ে দিয়েছে। ওই মামলায় জামিন না হলে তিনি মুক্তি পাবেন না। ফলে বিষয়টি জরুরি দেখছি না। নথি আসুক, তখন জামিনের আবেদনটি দেখা হবে। এ মামলায় রেকর্ড না দেখে বেইল দিচ্ছি না।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে আসা প্রায় সোয়া ৩ কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ চার আসামির সবাইকে সাত বছর করে সশ্রম কারাদ- দিয়ে গত বছর ২৯ অক্টোবর এই মামলার রায় হয়। পাশাপাশি তাদের ১০ লাখ টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরো ছয় মাসের কারাদ- দেওয়া হয়। আর ট্রাস্টের নামে কেনা কাকরাইলের ৪২ কাঠা জমি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয় রায়ে। ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আখতারুজ্জামান এ মামলার রায় ঘোষণা করেছিলেন। রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি হাতে পাওয়ার চার দিন পর গেল বছর ১৮ নভেম্বর হাই কোর্টে আপিল করেন খালেদার আইনজীবীরা। এ মামলায় দ-িত চার আসামির মধ্যে খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী শুরু থেকেই পলাতক রয়েছেন। হারিছের তখনকার সহকারী একান্ত সচিব ও বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খানের আইনজীবী আখতারুজ্জামানও ইতোমধ্যে রায় পর্যালোচনা করে আপিলের সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছেন।
শুনানির শুরুতেই খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন,আমাদের প্রথম নিবেদন হচ্ছে, শুনানির জন্য আপিলটি গ্রহণ করা হোক এবং পরে জামিন আবেদন করব। তখন আদালত বলে, আমরা অ্যাডমিট করে দিচ্ছি। অর্থদ- স্থগিত করে দিচ্ছি। এ সময় জয়নুল আবেদীন বলেন, বিচারিক আদালত যে সম্পত্তি জব্দ করেছে, সেটি স্টে করলে তো মাই লর্ড আদারওয়াইজ হয়ে যাবে। এটা তো সম্পত্তি। স্ট্যাটাস ক্যু লাগবে। তখন বিচারক বলেন, ওকে স্ট্যাটাস ক্যু। তবে বেইল হবে না।
জয়নুল তখন বলেন, আবেদনটি একটু শোনেন মাই লর্ড, না শুনলে আমরা হতাশ হব। তখন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, না, শুনতে পারব না। শুনলে আদেশ দিতে হবে। জয়নুল আবেদীন বলেন, হ্যা, শুনলে তো আদেশ দিবেনই মাই লর্ড। আমাদের তো বেইল পিটিশন করার একটা রাইট আছে। বিচারক বলেন, আমরা তো বলছি, আমরা পরে শুনব। রেকর্ড আইনা দেন, আসলে পরে শুনব। জয়নুল আবেদীন তখন বলেন, তাহলে রেকর্ড আসার জন্য একটা তারিখ নির্ধারণ করে দেন সে তারিখের মধ্যে আসুক। আমাদের আবেদনকারী অসুস্থ, তার অবস্থা খুব ভালো না। বিচারক বলেন, আরেকটা কেসে ওঁর বেইল পেন্ডিং আছে। আমরা যদি এই মামলায় উনাকে বেইল দেইও তাহলে উনি মুক্তি পাবেন না। যেহেতু আরেকটি মামলায় আটক আছেন সেহেতু আমরা বেইল দিচ্ছি না। জয়নুল আবেদীন বলেন, আরেকটা না, আরও ১০টা কেসে উনি থাকতে পারেন। সবগুলো কিন্তু আপনি আমলে নিবেন না। অনেক জিনিস থাকতে পারে। কিন্তু আগেই যদি বলে দেন তাহলে আমাদের জন্য সেটা… প্লিজ মাই লর্ড একটা ডেট দিয়ে দেন।
জ্যেষ্ঠ বিচারক তখন বলেন, আমরা যে সব সময় বেইল দেই না তা না। কখনও কখনও দেই। রেকর্ডটা আসুক আমরা দেখব।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রেকর্ডের কথা উল্লেখ করে জয়নুল আবেদীন তখন বলেন, এর আগে রেকর্ডটা আনার একটা ডেট দিয়েছিলেন। ডেট অনুযায়ী রেকর্ড এসছে এবং রেকর্ড আসার সাথে সাথেই বেইল দিয়েছিলেন। বিচারক তখন বলেন, ওইটা পাঁচ বছরের মামলায় দিয়েছিলেন। পরে সাজা পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে ১০ বছর করেছিল। আমরাও যে দেই না তা না। এই বেইল দিলে কোনো লাভ হবে, উনি বের হতে পারবেন? জয়নুল বলেন, না। বিচারপতি বলেন, যেহেতু একটি মামলায় পাঁচ বছরের সাজা উচ্চ আদালত ১০ বছর করেছিল, এনহ্যান্স করেছিল। ওই মামলায় তারা বেইল দেবে না, তাই আমরাও দিচ্ছে না। জয়নুল বলেন, আপনাদের তো তার আগে বেইল দিতে বাধা নাই। লিগ্যাল কোনো গ্রাউন্ড নাই। বিচারক বলেন, আগে রেকর্ড আসুক, আমরা দিয়ে দিব। জয়নুল বলেন, তাহলে এক সপ্তাহের একটা সময় দিয়ে দেন। বিচারক বলেন, তিন মাসের আগে এই রেকর্ড পাঠাতেই পারবে না। জয়নুল বলেন, আপনি অর্ডার না করলে তো মাই লর্ড রেকর্ড আসবে না। এক সপ্তাহের মধ্যে আসার একটা আদেশ দেন। আগের কোর্ট দুই সপ্তাহের একটা আদেশ দিয়েছে মাই লর্ড। বিচারক বলেন, এই মামলায় তো সেই আর্জেন্সি নেই। মোস্ট আর্জেন্ট মাই লর্ড, বলেন জয়নুল আবেদীন। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, প্লিজ শোনেন মিস্টার জয়নুল আবেদীন, যেহেতু হাইয়েস্ট কোর্ট এনহ্যান্স করেছে সাজা। সেই সাজা পেন্ডিং আছে এবং এখন পর্যন্ত সে বেইল হয় নাই। জয়নুল আবেদীন তখন বলেন, দ্যাট ইজ অ্যা ডিফারেন্ট কেস মাই লর্ড। এইটা মাথায় না তুলে আপনি এইটা বিবেচনা করেন। জয়নুল বলেন, আমি আগেই বলেছি, বেগম খালেদা জিয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী, একটি রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসন; যেটি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। ফলে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিচারক বলেন, পার্লামেন্টেও তো যাচ্ছেন। জয়নুল আবেদীন তখন বলেন, দ্যাট ইজ দ্য ডিফারেনট ইস্যু মাই লর্ড। বিচারক বলেন, সাত বছরের মামলায় বেইল দেই না তা না। যেহেতু আরেকটা মামলায় ৫ বছর থেকে ১০ বছর বাড়িয়ে দিয়েছে, তাই বেইল দিচ্ছি না। জয়নুল বলেন, এটা ডিফারেন্ট কেস। বিচারক বলেন, না না। আমরা আমাদের চোখের সামনে দেখতেছি, একটি মামলায় হাইয়ার কোর্ট ৫ বছর বাড়িয়েছে। সেই মামলায় আপনাদের বেইল নাই। সেটাতে থাকলে আর্জেন্সি থাকত। আপনারা রের্ডগুলো পাঠিয়ে দেন, তারপর আসেন। এ সময় জয়নুল আবেদীন দুই সপ্তাহের সময় দেওয়ার অনুরোধ করেন। পরে তিনি তিন সপ্তাহের সময় দেওয়ার অনুরোধ করেন। বিচারপতি তখন বলেন, না, না। আমরা তিন মাসের নিচে দিব না। জয়নুল আবেদীন বলেন, দেয়ার আর টু বেঞ্চ মাই লর্ড। আমরা সিনিয়র বেঞ্চটাকে বেছে নিয়েছি কারণ আমরা ভরসা করেছি, এখানে একটা জাস্টিস পাব। বিচারক তখন জানতে চান, এটা কি ইনজাস্টিস হচ্ছে? তাহলে আউট অব লিস্ট করে দেই আপনারা অন্য কোনো বেঞ্চে যান। আমরা অর্ডার রিকল করে দিচ্ছি। মাহবুব উদ্দিন খোকন বলছেন, অর্ডার রিকল করি আমরা? তখন জয়নুল আবেদীন বলেন, রিকল কইরেন না মাই লর্ড। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, তিন মাসের একটা সময় বলে দিচ্ছি। আপনারা ১৫ দিনের মধ্যে নিয়ে আসেন। তিন মাসে কি সর্বনাশ হয়ে যাবে? এ পর্যায়ে মাহবুব উদ্দিন খোকন অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে বলেন, উনি কি দুদকের মাই লর্ড? এখানে উনি কিজন্যে আছেন? অ্যাটর্নি জেনারেল সরকার এবং দুদকের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। তখন অ্যাটর্নি জেনারেল দাঁড়িয়ে খোকনের বক্তব্যের আপত্তি জানালে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান উভয় পক্ষকে থামিয়ে বলেন, প্লিজ একথা বলবেন না মিস্টার খোকন। অ্যাটর্নি জেনারেল দেশের যে কোনো আদালতে থাকতে পারেন। জয়নুল আবেদীন তখন বলেন, আমাদের সাবমিশনটা তো রাখবেন মাই লর্ড। এখানে বারের অনেক আইনজীবী উপস্থিত আছেন। ফলে আমাদের একটা অধিকার আছে। তাই আমাদের আবেদন বিবেচনা করার অনুরোধ জানাচ্ছি। এই জিনিসটা তো আপনি একটু কনসিডার করবেন, সব সময় তো করে এসেছেন। একজন জুনিয়র আইনজীবী আসলেও তিন মাস সময়ই দিতেন। আমি নিবেদন করছি, আপনি একটু কনসিডার করেন মাই লর্ড। বিচারক তখন বলেন, যান যান, ঠিক আছে টু মানথস্।
এফএন/এমআর