ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
পরিচালন অদক্ষতায় লোকসানের বৃত্ত থেকে বেরোতে পারছে না বাংলাদেশ রেলওয়ে। যে কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালন দক্ষতা পরিমাপের অন্যতম মানদ- হচ্ছে অপারেটিং রেশিও। রাজস্ব আয়ের যতো শতাংশ পরিচালন ব্যয় হয় তা-ই অপারেটিং রেশিও। ওই রেশিও যতো বেশি, প্রতিষ্ঠানের পরিচালন অদক্ষতাও ততো বেশি। বিগত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ রেলওয়ের অপারেটিং রেশিও ছিল ১৯৬ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি ১০০ টাকা আয় করতে রেলওয়ের ব্যয় হয়েছে ১৯৬ টাকা। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতের রেল সংস্থার ক্ষেত্রে ওই হার ৯৬ শতাংশ। আর চীনে ৯৪ শতাংশ, জাপানে ৮৪, যুক্তরাষ্ট্রে ৬৩, পাকিস্তানে ১০৫ ও কানাডায় ৬১ শতাংশ। ওসব দেশের রেলের পরিচালন দক্ষতার দিক থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ে অসম্ভব রকম পিছিয়ে। পাশাপাশি বাংলাদেশ রেলওয়ের হিসাবেও ফাঁকি রয়েছে। পরিচালন ব্যয় হিসাব করার সময় অবচয় বিবেচনায় নেয়া অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ে পরিচালন ব্যয় হিসাবায়নে ডেপ্রিসিয়েশন বা অবচয় যোগ করেনি। আর অবচয় যোগ করা হলে বাংলাদেশ রেলওয়ের অপারেটিং রেশিও আরো অনেক বাড়বে। রেলপথ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দীর্ঘদিনের অবহেলিত রেলের উন্নয়নে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিগত ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর অনেকগুলো প্রকল্প হাতে নেয়। লক্ষ্য ছিল উন্নয়ন ও যাত্রীসেবার মান বাড়িয়ে রেলকে লাভজনক করে তোলা। ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৭-১৮ সময়ে রেলওয়ে ১৪ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার ৬৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। চলমান রয়েছে আরো ৪৮টি প্রকল্প। তাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৮ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বিপুল ওই ব্যয়ের পরও পরিচালন অদক্ষতার কারণে লোকসানের ধারা থেকে সংস্থাটি বের হতে পারছে না। সর্বশেষ গত অর্থবছরেও রেলের লোকসান হয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে সারা দেশে প্রতিদিন ৩৫২টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে। আর পণ্যবাহী ট্রেন চলছে ৫১টি। গত অর্থবছর রেলওয়ে যাত্রী পরিবহন থেকে ৯০৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা ও পণ্য পরিবহন করে ২৮৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা আয় করেছে। আর বিবিধ খাত থেকে আয় হয়েছে আরো ২৯৪ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে আয় দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৮৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা। বিপরীতে পরিচালন ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। সার্বিকভাবে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় রেলওয়ের পরিচালন দক্ষতা নিয়েই বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলছেন।
সূত্র জানায়, আয়ের ওপর বাংলাদেশ রেলওয়ের নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রতিদিন অসংখ্য যাত্রী বিনা টিকিটে রেলে ভ্রমণ করছে। আর ওই সুযোগ করে দিচ্ছে রেলের কর্মীরাই। তাছাড়া শুধুমাত্র যাত্রী পরিবহন করে রেলের পরিচালন ব্যয় তুলে আনা কঠিন। তবে পরিচালন ব্যয় তুলে আনার আরো অনেক উপায় আছে। সবচেয়ে বড় উপায় হলো কনটেইনার ও কার্গো পরিবহন বাড়ানো। কিন্তু ওই কাজটিই করতে পারছে না বাংলাদেশ রেলওয়ে। অথচ কনটেইনার পরিবহনের মাধ্যমে রেলের প্রাপ্ত আয় দিয়েই পরিচালন ব্যয়ের সিংহভাগ তুলে আনা যেতে পারে। তাতে যেমন রেলের আয় বাড়ার পাশাপাশি ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতো, তেমনি সড়কের ওপর চাপও অনেকটা কমে আসতো।
সূত্র আরো জানায়, বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে অদক্ষতার ছাপ বিদ্যমান। উন্নত দেশে রেল যখন লাভজনক, উন্নয়নশীল দেশগুলো যখন আয়-ব্যয়ে ভারসাম্য আনছে, তখন বাংলাদেশ রেলওয়ে ব্যয় করছে আয়ের দ্বিগুণ। বিগত ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ১০০ টাকা আয়ের পেছনে রেলের ব্যয় ছিল ১৮৭ টাকা। আয়-ব্যয়ের ওই অনুপাত সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় পৌঁছে ২০১১-১২ অর্থবছরে। ওই অর্থবছর ১০০ টাকা আয় করতে রেলের ব্যয় হয় ২৬০ টাকা। মূলত রক্ষণাবেক্ষণ খাতে বাংলাদেশ রেলওয়ের ব্যয় হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। গত এক দশকে ৪৬টি নতুন ইঞ্জিন ও ৩২০টি নতুন কোচ বহরে যোগ হলেও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ব্যয় কমেনি। সর্বশেষ অর্থবছর মোট ব্যয়ের ৩৪ শতাংশই হয়েছে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে। তাছাড়া বিবিধ খাতের ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে বিবিধ খাতের ব্যয় ১ শতাংশের কম, সেখানে বাংলাদেশে ওই ব্যয় প্রায় ২৭ শতাংশের কাছাকাছি। তাছাড়া জ্বালানি ব্যয়েও ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের রেল সংস্থার চেয়ে বিস্তর পিছিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে। মোট ব্যয়ের ১৪ শতাংশ জ্বালানি বাবদ চলে যাচ্ছে। যদিও ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রে ওই ব্যয় ৬ শতাংশের ঘরে। বাড়তি জ্বালানি ব্যয়ের পেছনে বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তেল চুরিকেই প্রধান কারণ বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তার বাইরে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় ১৩ দশমিক ৬৫, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ ৪ দশমিক ৪৯ এবং পরিচালনা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাতে ৭ দশমিক ২ শতাংশ ব্যয় হয়েছে গত অর্থবছর।
এদিকে পরিচালন অদক্ষতার পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর অতিনির্ভরশীলতাও রেলওয়ের ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। রেলে প্রতিটি টিকিটের পেছনে সফটওয়্যার ব্যবস্থাপনার জন্য কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম (সিএনএস) নিচ্ছে ৫ টাকা। ট্রেন ট্র্যাকিং সিস্টেমের জন্যও টিকিটপ্রতি আরো ৭ টাকা ব্যয় হচ্ছে। তার বাইরে অনলাইনে টিকিটপ্রতি রেলের ব্যয় হচ্ছে ২৫ টাকা। অর্থাৎ একটি টিকিট বিক্রিতেই ৩৭ টাকা ব্যয় করে ফেলছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। তাছাড়া একসময় রেলের নিজস্ব ধোপাখানা ছিল, এখন সেটি বন্ধ। ওই কাজে যুক্ত রয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য নিজস্ব বিভাগ থাকা সত্ত্বেও অবৈধ দখলে থাকা জমি শনাক্তের জন্য বিপুল টাকা ব্যয় করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। রেলের নিজস্ব যে স্লিপার কারখানা ছিল, সেটিও এখন বন্ধ। ফলে স্লিপারের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরই নির্ভর করছে রেল। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হওয়ার ক্ষেত্রে রেলের এমন পরনির্ভরশীলতাও অনেকাংশে দায়ী।
এদিকে এ প্রসঙ্গে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন জানান, রেলের উন্নয়ন সঠিক পথেই এগোচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত থাকায় রেল অনেক পিছিয়ে পড়েছে। ধারাবাহিক লোকসান থেকে বেরিয়ে আসতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। যাত্রীসেবার মান বাড়ানোই রেলওয়ের প্রধান লক্ষ্য। যদি যাত্রীদের সন্তোষজনক সেবা দেয়া যায়, তাহলে তাদের কাছ থেকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আহরণও সহজ হবে। তাছাড়া রেলের অনেকগুলো উন্নয়ন প্রকল্প চলমান আছে। ওসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে যাত্রীসেবা যেমন বাড়বে, তেমনি লোকসানি প্রতিষ্ঠানের তকমা থেকেও রেলকে বের করে আনা সম্ভব।
এফএন/এমআর