ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
দেশজুড়ে আশঙ্কাজনক হারে সাইবার অপরাধের ঘটনা বাড়ছে। প্রতি ২০ সেকেন্ডে একটি করে সাইবার অপরাধ ঘটছে। পুলিশসহ সরকারি সংশ্লিষ্ট সেলে প্রতিদিন জমা পড়ছে শত শত অভিযোগ। আর ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই নারী। তার পরেই রয়েছে তরুণ ও যুবকদের সংখ্যা। বর্তমানে সাইবার অপরাধ দমনে সরকার অনেক সোচ্চার ও জোরালোভাবে কার্যক্রম শুরু করেছে। তবে ওসব অভিযোগে বিচার ও শাস্তির হার খুবই কম। ফলে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও লোকলজ্জা, ভয়-ভীতি তথা হয়রানির ভয়ে অভিযোগ করে না। তাছাড়া স্বচ্ছ ধারণা না থাকা ও প্রতিকার পেতে অধিক সময়ক্ষেপণ হওয়ার কারণে অনেকেই অভিযোগের দায়ের অনীহা দেখায়। সাধারণত ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, গুগল, স্কাইপ- এ ভুয়া আইডি খুলে বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল ও ব্লগে মিথ্যা ও মানহানিকর তথ্য প্রচার, অশ্লীল ছবি ও ভিডিও আপলোড এবং মেসেজ পাঠিয়ে প্রতারণার ঘটনাগুলোই মোটা দাগে সাইবার অপরাধ হিসেবে পরিচিত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গতবছর ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৯ কোটি ছাড়িয়েছে। তার মধ্যে ৭০ ভাগই সাইবার অপরাধের ঝুঁকিতে আছে। আর ব্যবহারকারীদের মধ্যে ২০ ভাগ কোনো না কোনোভাবে সাইবার অপরাধের সঙ্গে জড়িত। মাত্র ১০ ভাগ ব্যবহারকারী সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন। একই তথ্যানুযায়ী দেশে বর্তমানে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। আর সাইবার অপরাধের ৭৫ ভাগ অভিযোগই ফেসবুককেন্দ্রিক। ইন্টারনেটের মাধ্যমে হয়রানি ও প্রতারণার শিকার হওয়া ৪৯ শতাংশই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। শুধুমাত্র ঢাকা মহানগর পুলিশের কাছেই সাইবার অপরাধ নিয়ে বছরে অভিযোগ জমা পড়ে ২০ হাজারও বেশি। তার মধ্যে মহানগর পুলিশের ‘হ্যালো সিটি’ অ্যাপসের মাধ্যমেই অভিযোগ জমা পড়ে ৬ হাজারেও বেশি। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সাইবার হেল্প ডেস্কেও বছরে ১০ হাজারের বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে।
সূত্র জানায়, দেশে মূলত ১৩ ধরনের সাইবার অপরাধের ঘটনা ঘটছে। তার মধ্যে- পারিবারিক বিদ্বেষ সৃষ্টি, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে বিরোধ তৈরি, উগ্র ও বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য প্রচার, ইউটিউবে অন্তরঙ্গ ভিডিও ও ছবি আপলোড, ফেক অ্যাকাউন্ট তৈরি, পাসওয়ার্ড বা গোপন নম্বর অনুমান করে আইডি হ্যাক, মোবাইল ব্যাংকিং, ই-কমার্স, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, অনলাইন এমএলএম (মাল্টি লেভেল মার্কেটিং), অনলাইনে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও অনলাইন গ্যাম্বলিং (জুয়া)। তবে দেশে সাইবার অপরাধ নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। তার মধ্যে পুলিশ সদর দফতরের লফুল ইন্টারসেপশন সেল (এলআইসি), কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল (সিসিটিসি) ইউনিটের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগ, অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টার, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সাইবার অপরাধ তদন্তবিষয়ক সেল, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সাইবার হেল্প ডেস্ক ও ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)। তারপরও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সাইবার হেল্প ডেস্ক ও ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) এবং পুলিশের ৫টি ইউনিটে সাইবার অপরাধ নিয়ে প্রতিদিন শত শত অভিযোগ জমা পড়ছে।
সূত্র আরো জানায়, বিগত ৬ বছরে সাইবার অপরাধের ঘটনায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে ৩ হাজার ৬৫৯টি। তার মধ্যে সাইবার ট্রাইব্যুনালে গেছে এক হাজার ৫৭৫টি মামলা। নিষ্পত্তি হয়েছে ৫২২টির। মাত্র ২৫টি মামলায় আসামিদের সাজা হয়েছে। পুলিশের ক্রাইম ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (সিডিএমএস) পরিসংখ্যান ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। পুলিশের ক্রাইম ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (সিডিএমএস) পরিসংখ্যান বলছে, সারাদেশে ২০১৩ সালে ৩৫টি ও ২০১৪ সালে ৬৫টি মামলা হয়। ২০১৪ থেকে ২০১৫ সালে মামলা হয় ৫৯৭টি যার মধ্যে ১৩৭টি ঢাকায়। ২০১৬ সালে সারাদেশে মামলা হয় ৮৭৯টি যার মধ্যে ঢাকায় ২০৬টি। ২০১৭ সালে মামলা হয় ১ হাজার ২৮টি। এর মধ্যে ঢাকায় ২৩৬টি। ২০১৮ সালে মামলা হয় ১ হাজার ৫৫টি যার মধ্যে ৩৩৩টি ঢাকায়। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালে শুধু ঢাকায় মামলা হয়েছে ৯১২টি। আর অপরাধের শিকার হওয়াদের মধ্যে শতকরা ৩৪ ভাগের বয়স ১৯ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। ৩১ ভাগের বয়স ২৬ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। ২৭ ভাগের বয়স ৩৬ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে। ৬ ভাগের বয়স শূন্য থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। আর দুই ভাগের বয়স ৫৫ বছরের বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্তদের ৫৩ ভাগ নারী, পুরুষ ৪৭ ভাগ। ২৩ থেকে ২৫ বছর বয়সী নারীরাই সবচেয়ে বেশি সাইবার অপরাধের শিকার হন।
এদিকে সাইবার অপরাধসহ অন্যান্য অপরাধের বিষয়ে অবহিতকরণে সবকারের তরফ থেকে নানান ই-সেবা চালু করা হয়েছে। তারমধ্যে- ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি সার্ভিস সেল সেন্টার ৯৯৯, ক্রাইম ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিডিএমএস), সিটিজেন ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিআইএমএস), আইজিপি কনপে¬ইন সেল ও বিডি পুলিশ হেল্প লাইনসহ বেশ কিছু বড় ই-সেবা ইতোমধ্যে আলাদাভাবে সেবা দিচ্ছে।
অন্যদিকে সাইবার অপরাধের বিচারের জন্য ২০১৩ সালের ২৮ জুলাই সাইবার ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠিত হয়। আর প্রতিষ্ঠার পর সারাদেশে ৩ হাজার ৬৫৯টি মামলার মধ্যে বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালে গেছে ১৫৭৫টি। তার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৫২২টি। ২৫টি মামলায় অপরাধ প্রমাণ হওয়ায় আসামিদের সাজা হয়েছে। তাছাড়া তদন্তে ত্রুটি, মামলার একপর্যায়ে বাদীর অনীহা, আদালতে সাক্ষীর হাজির না হওয়া, বাদী-বিবাদীর মধ্যে আপোশ ইত্যাদি কারণে মামলা খারিজ হয়ে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) সোহেল রানা জানান, অপরাধের ধরন ও ধাঁচের ভিন্নতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পুলিশের সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। সাইবার অপরাধ মোকাবিলার জন্য পুলিশের প্রতিটি ইউনিটে একটি করে সাইবার মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে। তাছাড়া পুলিশের সক্ষমতা বাড়াতে সর্বশেষ প্রযুক্তির সংযোজনসহ কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।
এফএন/এমআর