৫ দেশের সমন্বয়ে নতুন আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ফোরাম গঠনের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর

প্রথম পাতা » জাতীয় » ৫ দেশের সমন্বয়ে নতুন আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ফোরাম গঠনের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর
সোমবার ● ২২ এপ্রিল ২০১৯


ব্রুনাইয়ের সুলতান হাজী হাসানাল বলকিয়ার সঙ্গে আলোচনাকালে প্রধানমন্ত্রী

ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥

বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সদস্য পাঁচটি দেশের সমন্বয়ে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ফোরাম গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সোমবার (২২ এপ্রিল) সকালে ব্রুনাইয়ের সুলতানের সরকারি বাসভবন ইস্তানা নুরুল ইমান এ ব্রুনাইয়ের সুলতান হাজী হাসানাল বলকিয়ার সঙ্গে আলোচনাকালে প্রধানমন্ত্রী এ প্রস্তাব করেন।
আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বলেন, প্রস্তাবিত আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ফোরাম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (সিয়াকো) এর সদস্য হবে দক্ষিণ এশিয়া থেকে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও ব্রুনাই। পররাষ্ট্র সচিব জানান, প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে ব্রুনাইয়ের সুলতান আশ্বস্ত করেন যে, তিনি বিষয়টি নিয়ে ‘অনুকূল বিবেচনা’ করবেন। ব্রিফিংকালে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম ও বক্তৃতা লেখক নজরুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আলোচনায় রোহিঙ্গা সংকটসহ দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ সংক্রান্ত বিষয়গুলো স্থান পায়। মিয়ানমারে নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিজভূমে ফেরত পাঠাতে ‘সব ধরনের উদ্যোগ’ নেওয়া উচিত বলে মনে করছেন ব্রুনাই সুলতান হাজি হাসানাল বলকিয়া। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর এক ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে (সুলতান) বেশ বড় একটা বক্তব্য রেখেছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের সবাই মিলে একটা সমাধানে আসা উচিৎ। আমাদের সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ, যাতে তারা ফিরে যেতে পারে।
২০১৭ সালের অগাস্টে মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমন অভিযান শুরুর পর সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তার আগে বিগত কয়েক দশকে এসেছে আরও চার লাখ রোহিঙ্গা। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করেছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলো। তবে মিয়ানমার সেসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। মিয়ানমার বলে আসছে, তাদের নাগরিকদের মধ্যে যারা বাংলাদেশে আছে, যাচাই বাছাই করে তাদের ফিরিয়ে নিতে তারা তৈরি আছে। কিন্তু জাতিসংঘ বলছে, মিয়ানমারে এখনও রোহিঙ্গাদের ফেরার মত অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। আর রোহিঙ্গারা বলছে, নিরাপত্তার পাশাপাশি নাগরিকত্ব ও মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা পেলেই কেবল তারা ফিরে যাওয়ার কথা ভাববে। রোহিঙ্গাদের ফেরার মত অনুকূল পরিবেশ যেন মিয়ানমার তৈরি করে, সে বিষয়ে তাদের চাপ দিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিক যোগাযোগ চালিয়ে আসছে বাংলাদেশ।
শহীদুল হক বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা ইস্যুতে আসিয়ানের বড় ইনভলভমেন্ট চেয়েছেন এবং এ ব্যাপারে ব্রুনাইয়ের সুলতানের সহযোগিতা কামনা করেছেন। আর সুলতান রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আসিয়ানের ইনভলভমেন্টের কথা বলেছেন আসিয়ান হিউম্যানেটেরিয়ান সেন্টারের কনটেক্সটে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ‘শক্তিশালী’ করার ব্যাপারে ব্রুনাই সবসময় সহায়তা করে যাবে- এমন আশ্বাস সুলতানের তরফ থেকে এসেছে বলে জানান পরারাষ্ট্র সচিব।
সুলতানের আমন্ত্রণে তিন দিনের সরকারি সফরে গত রোববার বন্দর সেরি বেগওয়ানে পৌঁছান শেখ হাসিনা। সোমবার সকালে তিনি সুলতানের বাসভবনে পৌঁছালে প্রটোকল ভেঙে এগিয়ে এসে সুলতান বলকিয়ার ও যুবরাজ হাজী আল মুহতাদি বিল্লাহ তাকে স্বাগত জানান। রাজ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর সুলতানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর। বৈঠক শেষে তাদের উপস্থিতিতে ছয়টি সমঝোতা স্মারকে সই ও একটি কূটনৈতিক নোট বিনিময় হয়।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বিগত নির্বাচনে জিতে টানা তৃতীয়বারের মত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করায় শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান সুলতান। তিনি বলেন, ‘এটা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের স্বীকৃতি হিসেবে জনগণের রায়।’ দুই দেশের সম্পর্কের সম্প্রসারণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই সফর মাইলফলক হয়ে থাকবে বলেও মন্তব্য করেন সুলতান। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর যে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে, সে বিষয়টি বৈঠকে তুলে ধরেন সুলতান বলকিয়া। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বাংলাদেশের চলমান আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সুলতানের সঙ্গে বৈঠকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ছয়টা প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দুদেশের ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মধ্যে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। এজন্য দুদেশের মধ্যে একটা প্রেফারেনশিয়াল ট্রেড অ্যারেঞ্জেমেন্ট করার বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দুদেশের মধ্যে জয়েন্ট কমিশন করার ব্যাপারে আমাদের মধ্যে আলোচনা করা দরকার। পাটজাত পণ্য, কৃষি পণ্য, সফটওয়্যার, জাহাজ, সিরামিক এসব পণ্যের কথাও তিনি তুলে ধরেছেন। সুলতান এসব ব্যাপারে ‘খুব ইতিবাচক’ উত্তর দিয়েছেন জানিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশে যে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে সেখানে ব্রুনাইয়ের ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করতে পারে বলে সুলতানকে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে দুই দেশের মধ্যে দ্বৈত কর পরিহারের ওপরও জোর দিয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতের কথা উল্লেখ করে বিশেষ করে ফার্মাসিউটিক্যালসে ব্রুনাইয়ের সঙ্গে বড় ধরনের সহযোগিতা হতে পারে বলে তিনি মত দিয়েছেন।
পররাষ্ট্র সচিব জানান, দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বিমান যোগাযোগ চালুর বিষয়টি দুই নেতার কথাতেই এসেছে। প্রবাসী শ্রমিকদের ব্যাপারে একটি ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ করার প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। নন-উইপেন রিলেটেড অঞ্চলে সামরিক সহযোগিতার বিষয়ও আলোচনায় এসেছে। হিউম্যানিটি, অপারেশন্স, নলেজ শেয়ারিং, সুলতানও কিন্তু শান্তি মিশনে বাংলাদেশের অবদানের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ের সময় প্রেস সচিব ইহসানুল করিম ও স্পিচ রাইটার নজরুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে রবিবার ব্রুনাই পৌঁছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী। দ্য এম্পায়ার হোটেল অ্যান্ড কান্ট্রি ক্লাবের বলরুমে প্রবাসীদের দেওয়া এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেসব দেশ খাদ্য আমদানি করে, বাংলাদেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্য দিয়ে সেখানকার বাজার ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের বিরাট সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। যেখানেই আমরা যাচ্ছি ব্যবসা-বাণিজ্যটা যেন বৃদ্ধি পায়, সেই চেষ্টাটা আমরা করছি। আজকে আমরা খাদ্য উপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সেখানে আমরা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করতে পারি। সেটা প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিদেশে রপ্তানিকরণ।
শেখ হাসিনা বলেন, এই অঞ্চলের বহু দেশ আছে খাদ্য তারা বাইরে থেকে আনে। আমরা ধীরে ধীরে সেই মার্কেটটা ধরার চেষ্টা করছি। যেন আমাদের উৎপাদিত পণ্য প্রক্রিয়াজাত করে আমরা পাঠাতে পারি। আমরা যদি ভালো করে করতে পারি, বিরাট মার্কেট পাব। প্রধানমন্ত্রীর ব্রুনাই সফর উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (দ্বিপক্ষীয়) মো. কামরুল আহসান বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারীদের একটি ব্রুনাই। তারা আমাদের কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে বিনিয়োগ করতে পারে। তাদের চাহিদা মত খাবার প্রস্তুত করে এখান থেকে রপ্তানি করতে পারে। ব্রুনাই ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য মাত্র ১০ লাখ ডলারের মতো। এটাকে আরও বাড়ানোর পথ তৈরির জন্য প্রধানমন্ত্রীর সফরে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মন্ত্রী, উপদেষ্টাসহ কয়েকজন প্রতিমন্ত্রীও সফরে গেছেন। সঙ্গে আছেন এফবিসিসিআই, এমসিসিআই, বিজিএমইএ সভাপতিসহ ব্যবসায়ীদের একটি বড় প্রতিনিধি দল। প্রবাসীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তাদের কল্যাণে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ও সমস্যা বাস্তবায়নের কথা তুলে ধরেন। শেখ হাসিনা প্রবাসের অভিজ্ঞতা দেশে কাজে লাগানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, যারা এখানে বড় বড় কাজগুলো করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে আপনাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারলে উন্নয়নে কাজে দেবে। দেশে কর্মসংস্থান বাড়ানোর লক্ষ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কথা উল্লেখ করেন তিনি। তিনি প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে সারাদেশে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বাড়ানোসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের কথা তুলে ধরেন। এ ছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের নানা উন্নয়মূলক কাজের চিত্রও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
ব্রুনাইতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার অবসরপ্রাপ্ত এয়ার ভাইস মার্শাল মাহমুদ হোসাইনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কৃষিমন্ত্রী মো. আবদুর রাজ্জাক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমদ, যুব এবং ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ প্রমুখ।
দুপুরে পৌঁছানোর পর ব্রুনাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে উ অভ্যর্থনা জানানো হয়, তাকে স্বাগত জানান দেশটির যুবরাজ হাজী আল মুহতাদি বিল্লাহ। বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়, দেওয়া হয় লাল গালিচা সংবর্ধনা। ব্রুনাইয়ের রয়্যাল গার্ডের একটি চৌকস দল প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার দেয়। এ সময় দুই দেশের জাতীয় সংগীত বাজানো হয়। এরপর মোটর শোভাযাত্রা করে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে যাওয়া হয় দ্য এম্পায়ার হোটেল অ্যান্ড কান্ট্রি ক্লাবে। তিন দিনের এই সরকারি সফরে প্রধানমন্ত্রী এই হোটেলেই অবস্থান করছেন।

এফএন/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ১৬:২৫:২৩ ● ৪৪৮ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ