চট্টগ্রাম সাগরকন্যা প্রতিনিধি॥
বর্ষায় পাহাড় ধসে মাটিচাপায় প্রায়ই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে এড়াতে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বাসকারীদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে প্রশাসন। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন ব্যক্তিমালিকানাধীন ১৭টি অতিঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের হালনাগাদ তালিকা তৈরি করেছে। ওসব পাহাড়ে ৮৩৫টি পরিবার বসবাস করছে। ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী ওসব পরিবারকে দখল ছাড়ার জন্য ইতিমধ্যে নির্দেশ দিয়েছে প্রশাসন। অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত ওসব পাহাড়ের মধ্যে ১০টিই ব্যক্তিমালিকানাধীন, যেখানে ৩০৪টি পরিবারের বসবাস। বাকি ৭টি পাহাড় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, রেলওয়ে, চট্টগ্রাম ওয়াসা, গণপূর্ত ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মালিকানায় রয়েছে। ওসব পাহাড়ে ৫৩১ পরিবার বসবাস করছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ২০০৭ সালের জুন মাসে পাহাড় ধসে ১২৭ জন মারা যাওয়ার ঘটনার পর চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো তদারকি ও প্রাণহানি রোধে তখন দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তখন ১৮ সদস্যের পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটিও গঠন করা হয়। কিন্তু ওই কমিটির কার্যক্রম গত এক যুগে শুধু বর্ষা মৌসুমে বৈঠক আয়োজন আর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার নির্দেশনায় সীমাবদ্ধ রয়েছে। তবে বিভিন্ন সময়ে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি পাহাড় ধসের ২৮টি কারণ চিহ্নিত করে সমস্যা সমাধানে ৩৬ দফা সুপারিশ উপস্থাপন করে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পাহাড়ে বসবাসকারীদের পুনর্বাসন, পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, নীতিমালা প্রণয়ন, নিরাপত্তা প্রাচীর নির্মাণ, বালি উত্তোলন নিষিদ্ধকরণ, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে অবৈধ বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ, পাহাড়ের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা নির্মাণের অনুমতি না দেয়া ও ৫ কিলোমিটারের মধ্যে হাউজিং প্রকল্প না করা। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতার কারণে ১২ বছর পেরোলেও পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে বিগত ১২ বছরে পাহাড় ধসে প্রায় ২৫০টি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
সূত্র জানায়, বিগত বছরগুলোতেও বর্ষা মৌসুম আসার আগে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি নির্দেশনা দিলেও বসবাসকারী পরিবারগুলোকে পাহাড় থেকে সরানো যায় না। তাছাড়া পাহাড়ে কীভাবে মানুষ বসবাস করে সে বিষয়ে কোনো নজরদারি নেই। শুধু বর্ষা মৌসুম এলেই সংশ্লিষ্ট কমিটি কাজ দেখাতে ব্যস্ত হয়। পাহাড়ে বসবাস অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও কিভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ দিচ্ছে, তার বিরুদ্ধে প্রশাসনকে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। তবে এবার চট্টগ্রামের ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করতে জেলা প্রশাসন ৩ মার্চ পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসরতদের হালনাগাদ তালিকা চেয়ে নগরীর সদর, কাট্টলি, চান্দগাঁও, বাকলিয়া, আগ্রাবাদ ও পতেঙ্গা সার্কেলের সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে চিঠি পাঠায়। ওই চিঠিতে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় ও ওসব পাহাড়ে অবস্থানকারীদের সম্পর্কে তথ্য চাওয়া হয়। ওই নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে ওই ৬ অঞ্চলের সহকারী কমিশনাররা (ভূমি) ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের নাম ও মালিকানা, অবৈধ বসবাসকারীর নাম, পরিবারের সদস্য সংখ্যা উল্লেখ করে একটি হালনাগাদ প্রতিবেদন জেলা প্রশাসনের কাছে জমা দিয়েছে। তাতে চট্টগ্রামে ২৮টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের কথা উল্লেখ করা হলেও ১৭টি পাহাড়কে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছে জেলা প্রশাসন। ওসব পাহাড়ে মোট ৮৩৫টি পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে অবস্থান করেছে। তার মধ্যে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ, গণপূর্ত অধিদপ্তর ও ওয়াসার মালিকানাধীন মতিঝর্ণা ও বাটালি হিলসংলগ্ন পাহাড়ে ১৬২, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন কৈবল্যধামের বিশ্ব কলোনি পাহাড়ে ২৮, পরিবেশ অধিদপ্তরসংলগ্ন সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন পাহাড়ে ১০, রেলওয়ের মালিকানাধীন লেক সিটি আবাসিক এলাকাসংলগ্ন পাহাড়ে ২২ ও পূর্ব ফিরোজ শাহ ১ নং ঝিলসংলগ্ন পাহাড়ে ২৮টি পরিবার বসবাস করছে। তাছাড়া ব্যক্তিমালিকানাধীন ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটসংলগ্ন পাহাড়ে ৩৩৪, পলিটেকনিক কলেজসংলগ্ন পাহাড়ে ৪৩, মধু শাহ পাহাড়ে ৩৪, হারুন খান সাহেবের পাহাড়ে ৩৩, মিয়ার পাহাড়ে ৩২, এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানি পাহাড়ে ২৬, আকবর শাহ্ আবাসিক এলাকাসংলগ্ন পাহাড়ে ২৮, আমিন কলোনিসংলগ্ন ট্যাংকির পাহাড়ে ১৬, ভিপি সম্পত্তি লালখান বাজার জামেয়াতুল উলুম মাদ্রাসাসংলগ্ন পাহাড়ে ১১, ফয়’স লেক আবাসিক এলাকাসংলগ্ন পাহাড়ে নয়, এমআর সিদ্দিকীর পাহাড়ে আট ও ভেড়া ফকিরের পাহাড়ে ১১টি পরিবার বসবাস করছে।
সূত্র আরো জানায়, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ১৯তম বৈঠকে আগামী ১৫ মের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ১৭টি পাহাড়ে অবস্থানকারী ৮৩৫টি পরিবারকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। একই সঙ্গে ওসব পাহাড়ে বসবাসকারীদের মধ্যে অবৈধভাবে দেয়া গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ ১৫ দিনের মধ্যে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত দিয়েছে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি।
এদিকে এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন জানান, ইউটিলিটি সার্ভিস প্রোভাইডার (কেজিডিসিএল-পিডিবি-ওয়াসা) যারা আছে, তাদের এখন থেকেই কাজ শুরু করতে চিঠি দেয়া হয়েছে। তারা যদি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নের কাজ শুরু না করে, ওসব পাহাড়ে যদি দুর্ঘটনায় কারো প্রাণহানি ঘটে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হবে।
অন্যদিকে একই প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ও পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আবদুল মান্নান জানান, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম এলে পাহাড় নিয়ে এ অঞ্চলের মানুষ আতঙ্কে থাকে। একজন মানুষও যাতে মাটিচাপা না পড়ে, সেদিকে নজর দেয়া হয়েছে। কোনো দুর্বৃত্ত যদি পাহাড়ে বসবাসকারীদের প্ররোচনা দেয়, তাদের চিহ্নিত করতে হবে। আগামী ১৫ মের মধ্যে ওসব পাহাড়ে যেসব দখলদার আছে, তাদের সরিয়ে নিতে সংশ্লিষ্টদের কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আর সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের নিজ উদ্যোগেই পাহাড়কে অবৈধ দখলমুক্ত করতে হবে।
এফএন/এমআর