হেমন্ত বিশ্বাস, গোপালগঞ্জ থেকে॥
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার বর্ণি ইউনিয়নের ১৩ বছরের কিশোরী লাবন্য (ছদ্মনাম)। বাবা বাসের হেলপার। মা করে ঝিঁ এর কাজ। ৬ সদস্যের টানাটানির সংসারে থেকে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আয়ার চাকরীর প্রলোভনে পড়ে সে। সেই সূত্রে ৬ মাস আগে লাবন্য’র মা লাবন্যকে তুলে দেয় ওই ইউনিয়নের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ পরিদর্শক জেসিকা বেগমের হাতে। আর সে সুযোগে জেসিকাও তাকে সুকৌশলে ব্যবহার করে নানা অসামাজিক কার্যকলাপে। চাকরির বিনিময়ে অফিসারদের খুশী করার নাম করে একের পর এক পুরুষের সঙ্গে তাকে যৌনকর্ম করতে বাধ্য করে। একপর্যায়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে স্থানীয়দের কাছে। আত্মসম্মান বাঁচাতে লাবন্য’র বাবা বাড়ি থেকে বের করে দেয় স্ত্রী ও মেয়েকে। উপায়ান্তর না দেখে গত ৩ এপ্রিল জেসিকা বেগমকে আসামী করে গোপালগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতণ দমন ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা দায়ের করে লাবন্য’র মা [মামলা নং-১৫০/১৯; ধারা ৮(১)]। কিন্তু তাতেও যেন তাদের নিস্তার নেই। মামলা তুলে নিতে তাদের উপর চলছে নানা হুমকি-ধমকি। এ দুঃসহ জীবন থেকে এখন পরিত্রাণ চায় লাবন্য।
লাবন্য’র মা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বাড়িতে আসা-যাওয়ার ফাঁকে তার কাছে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য-কেন্দ্রে লাবন্যকে আয়ার চাকরীর প্রস্তাব দেন জেসিকা। একটু ভালো থাকার আশায় তিনিও লাবন্যকে তুলে দেন জেসিকা’র হাতে। সেই থেকে লাবন্য থাকতো জেসিকা’র সরকারি বাসায়, আর আয়ার কাজ করতো ওই স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে।
লাবন্য জানায়, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আয়ার চাকরির কথা বলে নিয়ে তিনদিন পরই জেসিকা কৌশলে তার পরিচিত এক লোকের সঙ্গে তাকে যৌনকর্মে বাধ্য করে। ‘উনি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বড় অফিসার, উনার কথা শুনলে তোর চাকরি হবে’ - এমনসব প্রলোভনেও যখন সে রাজী হয়নি; তখন জোরপূর্বক বাধ্য করিয়েছে। এরপর জেসিকা জানালা দিয়ে মোবাইলে ভিডিও করে দিনের পর দিন তাকে ব্লাক-মেইল করেছে। একপর্যায়ে সে গর্ভবতী হয়ে পড়লে জেসিকা ঔষধ খাইয়ে তার গর্ভপাতও করায়। এরপর সে জেসিকার কাছ থেকে বাড়ি চলে এলেও ক’দিন বাদেই জেসিকা আবারও একই প্রলোভন দেখিয়ে তাকে স্বাস্থ্য-কেন্দ্রে নিয়ে যায়। দারিদ্র্যতার কারণে নিরুপায় হয়েই সে পা ফেলে জেসিকার ফাঁদে। এবার শুধু অফিসারদের সাথেই নয়, বিভিন্ন বয়সী পুরুষের সঙ্গেও রাত্রী যাপনে তাকে বাধ্য করে। কিন্তু দু’বেলা দু’মুঠো ভাত, পুরোনো পোষাক আর চাকরির আশ্বাস ছাড়া কিছুই জোটেনি তার। তাই এ দু:সহ জীবন থেকে পরিত্রাণ পেতে সে আদালতের দারস্থ হয়েছে।
এলাকার মুরুব্বী শরিফুল আলম খালাসী, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের লাগোয়া বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা মোক্তার হোসেন (অবসরপ্রাপ্ত এসআই) ও বর্ণি ৩নং ওয়ার্ড মেম্বার জাহাঙ্গীর ফরাজী সহ অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২৫ মার্চ রাতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অভ্যন্তরে এমন কর্মকান্ডে লিপ্ত দু’যুবক ও লাবন্য হাতেনাতে ধরা পড়ে স্থানীয়দের কাছে। পরে পার্শ্ববর্তী বর্ণি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রমজান আলীর বাড়ীতে ১৫-২০ জন লোকের উপস্থিতিতে এক গোজামিলের মীমাংশা হয়।
মুরুব্বীরা আরও বলেছেন, জেসিকা এর আগেও ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একই ধরণের ঘটনা ঘটিয়েছে - এলাকার সবাই জানে। তিনি নিজের খেয়ালখুশিমতো সেবাকেন্দ্রটি পরিচালনা করেন। রোগীদের সাথে ঝগড়াঝাটি ও দুর্ব্যবহার, ওষুধপত্র ঠিকমতো না দেয়া - এসব ডা: জেসিকার নিত্য ঘটনা। তার দুর্ব্যবহার ও মিথ্যাচারের কারণে এখন অনেকেই ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যায় না। তবে, দিনে-রাতে প্রায় সবসময়ই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিভিন্ন বয়সের পুরুষ লোক আসতে দেখা যায়। এতে ক্রমেই এলাকার গ্রাম্য-পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করে না। দু’এক জন মুখ খুললেও তারা মিথ্যা মামলাসহ নানা হয়রানীর শিকার হয়েছেন। তাই এ ঘটনায় তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবী করেন এবং সমাজ থেকে এসব নোংরা-আবর্জনা সমূলে নির্মূলের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের প্রতি আহবান জানান।
লাবন্য’র মায়ের দায়ের করা মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই সূত্রে জানা গেছে, তাদের তদন্তে জেসিকা বেগমের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রায় সবটারই প্রমাণ তারা পেয়েছেন। ডাক্তারী পরীক্ষার রিপোর্টটি হাতে পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।
গোপালগঞ্জ আড়াই’শ বেড জেনারেল হাসপাতালের সহকারি পরিচালক ডা. অসিত মল্লিক জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে তারা নিশ্চিত হয়েছেন লাবন্য ভার্জিনিটি হারিয়েছে। তবে আরও কিছু পরীক্ষা রয়েছে, সেগুলোর রিপোর্ট হাতে এলে ধর্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলা যাবে।
পরিবার পরিকল্পনা উপ-পরিচালক মো: মাজহারুল হক চৌধুরী বলেন, এ ব্যাপারে কোন অভিযোগ না পেলেও ওই এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে বিষয়টি শুনেছি। পুলিশ-তদন্তে অফিসের কোন লোক জড়িত থাকলে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।