চট্টগ্রাম সাগরকন্যা প্রতিনিধি॥
নতুন বছরকে বরণ করে নিতে পাহাড়ে পাহাড়ে শুরু হয়েছে বৈসাবি উৎসব। এর প্রথম অংশ শুরু হয় নদীতে ফুল ভাসিয়ে। চাকমা রীতিতে এই ফুল ভাসানের নাম ‘ফুল বিজু’। আর ত্রিপুরারা বলে ‘হারি বৈসুক’।
দেশের তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, বান্দরবন ও রাঙ্গামাটির ১৪টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষ এখন বর্ষবরণ ও বিদায়ের এই উৎসবে মাতোয়ারা। পাহাড়িদের জীবনে এটাই বছরের প্রধান সামাজিক উৎসব। তাদের বিশ্বাস, দেবতার উদ্দেশ্যে ফুল ভাসালে পুরানো বছরের গ্লানি থেকে মুক্তি মেলে।
তাই শুক্রবার (১২ এপ্রিল) ভোরের আকাশে রক্তিম সূর্যের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে রাঙামাটির চাকমা ও ত্রিপুরা তরুণ-তরুণীরা ফুলের ডালা হাতে দলে দলে হাজির হলেন কাপ্তাই হ্রদের তীরে। নতুন বছরে মঙ্গল কামনায় রাজবন বিহারের পূর্বঘাটে (রাজবাড়ি ঘাটে) কাপ্তাইয়ের জলে তারা ভাসিয়ে দিলেন ফুল। ত্রিপুরা রীতিতে এ উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ হল ঐতিহ্যবাহী গড়াইয়া নাচ, সঙ্গে বয়স্কদের বস্ত্র দানের আনুষ্ঠানিকতা। শনিবার চাকমাদের ‘মূল বিজু’, ত্রিপুরাদের ‘বুইসুকমা’ পালিত হবে। ১৮ এপ্রিল মারমা জনগোষ্ঠীর ‘সাংগ্রাই’ এর মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের বৈসাবি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি বাসিন্দারা ভিন্ন ভিন্ন নামে বর্ষবরণ উৎসব পালন করলেও উদযাপনের ধরন আর রীতি প্রায় একই রকম। ১৯৮৫ সাল থেকে খাগড়াছড়ি, বান্দরবান আর রাঙামাটির বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্মিলিতভাবে ‘বৈসাবি’ নামে এ উৎসব উদযাপন করে আসছে। বৈসাবি শব্দটি এসেছে ত্রিপুরাদের ‘বৈসু’, মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ আর চাকমাদের ‘বিজু’ উৎসবের নাম মিলিয়ে। এ উৎসব এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের ঐক্য আর বন্ধনের প্রতীক।
ত্রিপুরাদের ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসবের মধ্যে প্রধানতম উৎসব বুইসুক, বৈসুক বা বৈসু। চৈত্র মাসের শেষ দুই দিন ও নববর্ষের দিন পালন করা হয় এই উৎসব। চৈত্র মাসের শেষ দুই দিনের প্রথম দিনকে ‘হারি বুইসুক’ এবং শেষ দিনকে ‘বুইসুকমা’ বলে। আর নববর্ষের প্রথম দিনটি হল ‘বিসিকাতাল’। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে গতকাল শুক্রবার সকালে রাঙামাটি শহরের গর্জনতলী এলাকায় ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরামের আয়োজনে কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসান ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীরা। পরে জ¦ালানো হয় মঙ্গল প্রদীপ। উৎসবের প্রথমদিন ত্রিপুরা ছেলেমেয়েরা গাছ থেকে ফুল তুলে ঘর সাজায়। ঝুঁড়িতে ধান নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মোরগ-মুরগিকে ছিটিয়ে দেয়। এ দিন গৃহপালিত সব প্রাণিকে খুব ভোরে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরিচ্ছন্ন কাপড় পড়ে ছেলেমেয়েরা গ্রামে ঘুরে বেড়ায়; খবারের আয়োজনে থাকে হরেক রকম পিঠা। বৈসুক শুরুর দিন থেকে ‘গড়াইয়া’ নাচের দল গ্রামের বড়ি বাড়ি গিয়ে নাচ দেখায়। ২২টি অসাধারণ মুদ্রা সৃষ্টি করা এই নাচের দলের শিল্পীদের একজনের কাঁধে একটি শূল থাকে, যাতে বাঁধা থাকে একটি খাদি। যদি কোনো ঘরের উঠোনে এই শূলটি বসানো হয়, তাহলে ঘরের মালিককে গড়াইয়া দেবতার পূজা দিতে হয়। প্রত্যেক বাড়ির উঠোনে নাচ শেষে গৃহস্থরা শিল্পীদের মুরগির বাচ্চা, চালসহ অন্যান্য জিনিস দান করেন। বিনিময়ে শিল্পীরা সেই গৃহস্থকে সুর করে আশীর্বাদ করে। শিল্পীরা উপঢৌকন হিসেবে পাওয়া সামগ্রী দিয়ে গড়াইয়া দেবতার পূজা করেন। কোনো শিল্পী একবার এই নাচে অংশ নিলে তিন বছর পর পর এই নৃত্যে অংশ নিতে হয় তাকে। ১৬ থেকে ৫০০ জন পর্যন্ত এই লোকনৃত্যে অংশ নিতে পারেন। বৈসুক উৎসবের জনপ্রিয় এ নাচ দেখতে সারাদেশ থেকে পর্যটকরা পার্বত্য চট্টগ্রামে ভিড় করেন।
পুরানো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করার মারমা উৎসবকে বলে সাংগ্রাই। মারমারা সাধারণত চন্দ্রমাস অনুসারে এ দিনটি পালন করে। বছরের শেষ দুইদিন এবং নববর্ষের প্রথম দিনে এ উৎসব হয়।
চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে এ উৎসব পালন করা হয় বলে ‘সংক্রান্তি’ শব্দ থেকেই সাংগ্রাই শব্দটি এসেছে। এদিন সব্জি দিয়ে রান্না করা পাঁচন, পিঠা আর নানা মুখরোচক খাবারের আয়োজন থাকে মারমা পরিবারে। নতুন পোশাক পরে, পাড়া বেড়িয়ে, নেচে গেয়ে চলে আনন্দ উৎসব। বয়স্করা অষ্টশীল পালনের জন্য মন্দিরে যান। তরুণরা অংশ নেয় ‘ঘিলাখেলা’ নামে জনপ্রিয় একটি খেলায়। এ উৎসবের প্রধান আকর্ষণ জলকেলি। বাড়ির আঙিনায় প্যান্ডেল তৈরি করে বাদ্য আর গানের তালে তালে চলে এই পানি খেলা। ফুলে ফুলে সাজানো প্যান্ডেলে পবিত্রতার প্রতীক জল ছিটিয়ে মারমা তরুণ তরুণীরা নিজেদের শুদ্ধ করে নেয়।
চাকমারা তিন ভাগে ভাগ করে বিজু উৎসব পালন করে। চৈত্র মাসের ২৯ তারিখে ‘ফুলবিজু’, ৩০ তারিখে ‘মূলবিজু’ এবং বৈশাখের প্রথম দিনে ‘গজ্যাপজ্যা’ বিজু পালন করা হয়। ফুলবিজুর দিন চাকমারা বিজুর ফুল তুলে তা দিয়ে ঘর সাজায়। পরে সে ফুল নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। ফুল ভাসানোর পর্ব শেষে তরুণ-তরুণীরা ঘরে ফিরে বড়দের প্রণাম করে আশীর্বাদ নেয়। পাড়ার বয়স্কদের শরীরে পানি ঢেলে তাদের আশীর্বাদ কামনা করে। তাদের জন্য দেওয়া হয় নতুন পোশাক। বিজুর ফুল উৎসবে কথা হয় তিথি চাকমার সঙ্গে। গঙ্গা মাকে স্মরণ করে পানিতে ফুল ভাসিয়ে এসেছেন তিনি। তিথি বলেন, ফুল বিজু আমাদের আদি থেকে চলছে আসছে। আমরা এ ফুল বিজুর মধ্য দিয়ে নিজেদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চেষ্টা করছি। আর শতরূপা চাকমা বললেন, পুরোনো বছরের সব গ্লানি ধুয়ে মুছে ফেলার জন্যই আমাদের এ ফুল ভাসানো। আমরা দীর্ঘকাল ধরে ফুল ভাসিয়ে আসছি। আর ফুল বিজুর মধ্য দিয়েই আমাদের মূল বিজু উৎসবের শুরু হয়। বিজুর সময় বাড়িতে বাড়িতে হরেক রকম সবজি দিয়ে তৈরি হয় ‘পাঁজন’। আরও থাকে পায়েস, পিঠা, খই, নাড়ু, সেমাই ও পাহাড়ি মদ।
চাকমারা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে যোগ দেয় শোভাযাত্রায়; শিশু-কিশোর ও তরুণ তরুণীরা মেতে ওঠে খেলাধুলায়। সন্ধ্যায় বাড়ির উঠান ও গোশালায় প্রদীপ জ¦ালিয়ে সবার মঙ্গল কামনা এবং মন্দিরে গিয়ে মোম জ¦ালিয়ে পূজা করা হয়।
এফএন/এমআর