ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
সরকার নগদ টাকা সংকটে ভুগছে। মূলত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আয় না হওয়া, অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ বাবদ বেশি ব্যয় এবং বিদেশি ঋণ ও অনুদান কমে যাওয়ার কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে সরকারের নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা কমিটি (সিডিএমসি) মনে করছে। সরকারের নগদ স্থিতি যথাযথ পর্যায়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও মাঝেমধ্যেই তা রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। চলতি অর্থবছরের বিগত ৯ মাসে সরকারের হিসাব কয়েকবার নেতিবাচক অবস্থায় পড়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের শেষ কর্মদিবস ৩০ জুনে নগদ স্থিতিতে ৬ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম কার্যদিবস ২ জুলাই নগদ পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়ে ঘাটতি দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা। ২৪ জুলাই প্রথমবারের মতো ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি হয়। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত উদ্বৃত্ত বাড়তে থাকলেও ২৪ আগস্ট তা কমে ছয় হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। তারপর আবার বাড়লেও ১ অক্টোবর তা কমে ৫ হাজার কোটিতে নেমে আসে। তারপর থেকেই নগদ স্থিতি কমতে থাকে। গত ১৩ নভেম্বর সরকারকে একদিনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরাসরি (ওভার ড্রাফট খাতে) ঋণ নিতে হয়। যাকে ওডিসি বলা হয়ে থাকে। এ ধরনের ঋণ মূল্যস্ম্ফীতি সৃষ্টি করে। ডিসেম্বরে নগদ টাকার সংকট অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকায় ৪ ডিসেম্বর এবং ১০ থেকে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা ৪ দিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয়।
সূত্র জানায়, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়াই হচ্ছে সরকারের নগদ অর্থ সংকটের বড় কারণ। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এক লাখ ১৭ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ করেছে, যা ওই সময়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকা কম। সাত মাসে রাজস্ব আয়ে ৭ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে। আগের অর্থবছর একই সময়ে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২০ শতাংশের মতো। রাজস্ব আয় কম হওয়ার কারণে ব্যয় মেটাতে সরকারকে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ছয় মাসে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার নিট ঋণ নিয়েছে ৯ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা। অথচ বিগত অর্থবছর সরকারকে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিতে হয়নি, উল্টো পরিশোধ করেছে ২ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংক ঋণের সুদ বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৭ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা, আগের অর্থবছরের একই সময়ে এটি ছিল ৭ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা।
সূত্র আরো জানায়, রাজস্ব ঘাটতি মেটানো ও বাড়তি ব্যয় নির্বাহে সঞ্চয়পত্র থেকেও সরকারকে বিপুল অর্থ ঋণ নিতে হচ্ছে। জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি ঋণ নিয়েছে সরকার। ওই সময়ে নিট ৩৫ হাজার ৬০২ কোটি ৪৯ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। বাজেটে এ খাত থেকে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ সরকারকে ১১ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে, আগের অর্থবছরের একই সময়ে তা ছিল ৯ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ সরকারের ব্যয় বেড়েছে ১৮ শতাংশ। সরকারের অর্থায়ন ঘাটতি মেটানোর অন্যতম আরেকটি উৎস বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের পরিমাণ গত অর্থবছরের তুলনায় কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বৈদেশিক উৎস থেকে সরকারের পাওয়া নিট ঋণের পরিমাণ ১৭ হাজার ২৯০ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ কমেছে ৯ শতাংশ।
এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকারের নগদ হিসাবে ঘাটতি অস্বাভাবিক নয়। সরকার যেহেতু ঘাটতি বাজেট করে, অর্থাৎ আয়ের তুলনায় ব্যয়ের হিসাব বেশি থাকে, ফলে হিসাবে ঘাটতি হবে। এতে লেনদেন বা দৈনন্দিন কার্যাবলিতে সমস্যা হয় না। সরকারের সিংহভাগ কাজ চেক বা পে-অর্ডারে হয়ে থাকে। তবে ন্যূনতম জরুরি প্রয়োজন মেটাতে সরকারের হিসাবে অর্থ থাকা ভালো। অর্থবছরের শেষ মাস বা জুনে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের বকেয়া বিল পরিশোধ হয় বিধায় ওই মাসে সাধারণত সরকারের হিসাবে নগদ টাকার সংকট দেখা দেয়। ওই সংকট জুন সিনড্রোম নামে পরিচিত। এ বছর এই জুন সিনড্রোম বারবার ফিরে এসেছে।
অন্যদিকে অর্থনীতিবিদদের মতে, নগদ টাকার সংকট সৃষ্টির প্রধান কারণ রাজস্ব সংগ্রহে ব্যর্থতা। বহু বছর ধরে রাজস্ব খাতে কোনো সংস্কার না হওয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। রাজস্ব খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া না হলে এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না। তাছাড়া সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদ এবং অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণও একটি কারণ। পাশাপাশি বিদেশি ঋণ ও অনুদান কম আসছে। মূলত নগদ টাকার সংকট থাকার কারণেই সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বেশি ঋণ নিচ্ছে। তাতে ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট আরো বাড়ছে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমছে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করবে।
এ বিষয়ে অতিসম্প্রতি অনুষ্ঠিত সরকারের নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা কমিটি (সিডিএমসি) ৪২তম সভায় কমিটির প্রধান অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার জানান, সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনা ও নগদ ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে।
এফএন/এমআর