ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
বিদ্যমান আইনের তোয়াক্কা করছে না বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বার বার আইন অমান্য করলেও ওসব প্রতিষ্ঠানের শাস্তির মুখোমুখি হচ্ছে না। ফলে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। আইনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারের কাছে আয়-ব্যয়ের হিসেব দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। একটি নির্দিষ্ট সময় পর স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ারও বিধান রয়েছে। তাছাড়া আইনে ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারার নিয়োগ দিয়ে পরিচালনা করা, নিয়মিত অর্থ কমিটি ও সিন্ডিকেট সভা করাও আইনে বিধান রয়েছে। কিন্তু হাতে গোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বেশিরভাগই এসব আইন অমান্য করেই পরিচালিত হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে বর্তমানে ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন রয়েছে। তারমধ্যে ৯০টি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ওসব বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে জমা দেয়া বাধ্যতামূলক। অথচ কয়েকদফা সময় বেঁধে দেয়ার পরও বেশিরভাগই প্রতিষ্ঠান তা মানেনি। ডিসেম্বর পর্যন্ত গতবছরের অডিট রিপোর্ট দেয়ার শেষ সময় ছিল। অথচ ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত মাত্র ৪১টি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অডিট রিপোর্ট জমা দিয়েছে। বাকি ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয় ওই নির্দেশনাকে আমলেই নেয়নি। এ ব্যাপারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলোর কাছে বারবার তাগিদ দিলেও কাজ হচ্ছে না। তাছাড়া যেসব প্রতিবেদন কমিশনে জমা হচ্ছে তাতেও প্রকৃত তথ্য উঠে আসছে না।অডিট রিপোর্ট না দেয়া কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের রোগে পরিণত হয়েছে। কারণ বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা কোনো নীতিমালা না মেনে ইচ্ছেমতো অর্থ ব্যয় করছে। শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি বাবদ আদায় করা টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা ইচ্ছেমত খরচ করারও অভিযোগ আছে। সম্প্রি ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা এক্সচেঞ্জ ও লিডারশিপ বিল্ডাপ প্রোগ্রামের নামে ফ্যামিলিসহ ইউরোপের ৬টি দেশ ভ্রমণ করেছে। তার আগে কানাডাতে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ট্রাস্টি বোর্ডের সভা করেছে। এমনকি নামিদামি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়েরও অভিযোগ রয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে দু’একটির বিরুদ্ধে তদন্তও করেছে দুদক।
সূত্র জানায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অহেতুক ব্যয়ের কারণে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষামানের উন্নয়নে কোনো অর্থ ব্যয় করা হয় না। মূলত ওই কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আয়-ব্যয়ের হিসাব এবং ওই সংক্রান্ত নিরীক্ষা প্রতিবেদন মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে জমা দিতে অনাগ্রহ। আর অনিয়ম আড়াল করতেই ওসব প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর অডিট রিপোর্ট দিচ্ছে না। আর যারা দিচ্ছে তারাও দায়সারাভাবে দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক স্বচ্ছতা আনতে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যারা অডিট রিপোর্ট দিচ্ছে না তাদের কড়া সতর্ক বার্তা দেয়া হচ্ছে। তারপরই চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ৪১টি বিশ্ববিদ্যালয় অডিট রিপোর্ট জমা দিয়েছে। এখনো যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অডিট রিপোর্ট দেয়নি তাদের জবাব সন্তোষজনক না হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের বলা আছে, যারা অডিট রিপোর্ট দিবে না তাদের বিরুদ্ধে ৪৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী ৫ বছরের কারাদ- বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান আছে।
সূত্র আরো জানায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী অনুমোদন পাওয়ার ৭ বছরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। বর্তমানে শিক্ষা কার্যক্রমে থাকা ৯০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৫৩টি অনুমোদন পাওয়ার সময়সীমা ৭ বছরের বেশি। অথচ ওসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ১৩টি স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে পেরেছে। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ২৫টি স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ করলেও সেখানে যাচ্ছে না। বরং রাজধানীতে বিভিন্ন ভবন, ফ্ল্যাট, বাসা ভাড়া নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। যদিও বিষয়টি নিয়ে প্রতিবছরই চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হয়। কিন্তু কোন কিছুইতেই কাজ হয়নি। মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের উচ্চপর্যায়ের একটি বৈঠকে ইউজিসির প্রণীত বেসরকারি বিশ্বদ্যালয়গুলোর সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সম্পূর্ণ ও আংশিক শিক্ষা কার্যক্রম নিজস্ব ও স্থায়ী ক্যাম্পাসে চালু করেছে এমন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা হচ্ছে ১৯টি। ১২টি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষাকার্যক্রম চালু করার ব্যাপারে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। ওসব প্রতিষ্ঠান প্রায় দুই যুগ আগে অনুমোদন পেলেও এখন পর্যন্ত নিজস্ব ও স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়ে তোলেনি। ওসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটিকে পৃথক চিঠি দিয়ে নিজস্ব ক্যাম্পাসে অনুমোদিত শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
এদিকে শুধু আর্থিক হিসেব না দেয়া কিংবা স্থায়ী ক্যাম্পাসে না যাওয়াই নয়, প্রতিষ্ঠানের অর্থ কমিটি, সিন্ডিকেট সভা না করা, ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারার ছাড়াই অহরহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ঘটনাও ঘটছে। আইন অনুযায়ী কেবল চ্যান্সেলর নিযুক্ত বৈধ ভিসিই সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ডিগ্রির সনদে সই করতে পারেন। অথচ বৈধ ভিসি ছাড়াই চলছে বহু বিশ্ববিদ্যালয়। বিগত ২০১৮ সাল পর্যন্ত অনুমোদন পাওয়া ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২৩টিতে নেই কোন ভিসি। প্রো-ভিসি ছাড়া ৭১টি ও ট্রেজারার ছাড়া পরিচালিত হচ্ছে ৫১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ ওই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদ ছাড়া উচ্চশিক্ষা দানকারী কোনো প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না। কোষাধ্যক্ষ ছাড়া কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা এবং আর্থিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা যায় না। আবার যেখানে ট্রেজারার আছে, সেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের পছন্দের লোক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এভাবে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা অর্থ আত্মসাৎ করছে বোর্ড অব ট্রাস্টি (বিওটি’র) সদস্যরা।
অন্যদিকে সম্প্রতি ইউজিসি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে একটি প্রতিবেদনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে আর্থিক অস্বচ্ছতার অভিযোগ তুলেছে। একাডেমিক, প্রশাসনিক অনিয়ম ছাড়াও সার্টিফিকেট বিক্রি সিন্ডিকেটের নামে অর্থ আত্মসাৎ, গবেষণায় খাতের টাকা খরচ না করে আত্মসাতের মতো আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়াসহ ১৬ ধরনের অনিয়ম তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে এসব অনিয়মের জন্য ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য, ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারারকে দায়ি করা হয়। তবে এ বিষয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলছেন, আইন কানুন যা করেছে তা যথেষ্ট না। অন্য যেসব সমস্যা আছে তা সমাধান না করে শুধু আইন চাপিয়ে দিতে চায়।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান জানান, কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে একটিও সিন্ডিকেট, অর্থ কমিটি ও বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভা হয় না। এটি সম্পূণরূপে আইনের লঙ্ঘন। অনেকে উচ্চশিক্ষাকে বিনিয়োগ এবং মুনাফা লাভের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু এটি মুনাফা লাভের জন্য নয়। তবে বেশকিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের আইন-কানুন যথাযথভাবে পালন করে যাচ্ছে এবং কাক্সিক্ষত শিক্ষা প্রদান করছে। আর বারবার বলার পরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাচ্ছে না। তাদের কারণে সম্ভাবনাময় এই সেক্টরের বদনাম হচ্ছে।
একই প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালনা করতে হলে আর্থিক স্বচ্ছতা অবশ্যই বজায় রাখতে হবে। যারা আইন মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। সেক্ষেত্রে কে প্রভাবশালী, কে প্রভাবশালী না তা মূখ্য না। কারণ কেউ স্বচ্ছতার বাইরে নয়। সবাইকে আইন মানতে হবে।
এফএন/এমআর