ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
সারাদেশে রেলের হাজার হাজার একর জমি বেহাত হয়ে রয়েছে। কিন্তু ওসব জমি উদ্ধারে জোরালো তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। বর্তমান সরকার রেল, নদী ও সড়কের অবৈধ দখলকৃত জমি উদ্ধারে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করে। আর ওই কর্মসূচির শুরুর পর এক মাসে (ফেব্রুয়ারি-মার্চ) সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ১৮শ’ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বেদখল হওয়া ২০০ কোটি টাকা মূল্যের জমি উদ্ধার হয়। কিন্তু একই সময়ে রেলের জমি উদ্ধারে কয়েকটি অভিযান চললেও উল্লেখ করার মতো কোন উচ্ছেদ হয়নি। রেল মন্ত্রী নিজেও দখলকৃত জমি উদ্ধারে অভিযান শুরু না হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে তবে শিগগিরই অভিযান শুরু হবে বলে জানিয়েছেন। বাংলাদেশ রেলপথ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সারা দেশে রেলওয়ের মালিকানাধীন জমি রয়েছে প্রায় ৬১ হাজার ৬০৫ দশমিক ৮৪ একর। তার মধ্যে রেলওয়ে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করছে ৩১ হাজার ৩১১ দশমিক ৫০ একর জমি। তাছাড়া ৭৯৫ দশমিক ১৯ একর মৎস্য, ৩০ দশমিক ৫৫ একর নার্সারি, ১২ দশমিক ৪৭ একর সিএনজি, ৪৫ দশমিক ৬৭ একর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ২১০ দশমিক ৬৯ একর সরকারি-আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কাছে লাইসেন্সের মাধ্যমে ইজারা দেওয়া আছে। বাণিজ্যিক লাইসেন্সের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দেয়া হয়েছে ৯০৯ দশমিক ৮৪ একর জমি। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত রেলওয়ের প্রায় ৪ হাজার ৪৬৫ দশমিক ৬২ একর জমি বেহাত হয়ে গেছে। তার মধ্যে শুধু পশ্চিমাঞ্চলেই দখল হয়েছে ৩ হাজার ৩৮৭ দশমিক ২৭ একর। আর পূর্বাঞ্চলে ১ হাজার ৭৮ দশমিক ১৫ একর। তাছাড়া সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে খাতা-কলমে (শক্ত ডকুমেন্ট ছাড়া) লিজ বা ইজারা দেয়া আছে ১২ হাজার ৭২১ দশমিক ৪ একর জমি। আর বর্তমানে রেলের দখলে অব্যবহৃত জমি রয়েছে মাত্র ১৩ হাজার ১০৭ একর। তার মধ্যে কৃষি জমি ১০ হাজার ৭১৬ দশমিক ৮১ একর।
সূত্র জানায়, যুগ যুগ ধরে অবৈধভাবে রেলের জমি বেদখল হলেও রেলের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তেমন মাথা ব্যাথা নেই। ফলে জমি উদ্ধারে দীর্ঘদিনের নিষ্ক্রিয়তায় ইইতিমধ্যে অনেক জায়গা পুরোপুরি বেদখল হয়ে গেছে। প্রভাবশালীরা কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই রেলের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসে রেলের জমি দখল অব্যাহত রেখেছে। ওসব দখলদাররা অবৈধভাবে দখলকৃত জায়গায় কাঁচা-পাকা স্থাপনা এবং অবৈধ দোকান ও বস্তি বসিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর ওসব বেহাত হওয়া জমি উদ্ধারে বিভিন্ন সময়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হলেও কার্যত কোন সফলতা আসেনি। অবৈধ দখলদাররা রেলের জমি দখলের সাথে সাথে রেল লাইনের দু’ধারে বড় বড় মাদকের আখড়া গড়ে তুলেছে। তাতে একদিকে রেল লাইনে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি যেমন বেড়েছে, তেমনি জমি থেকে প্রাপ্ত বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। তাছাড়া ওসব মাদক আখড়া থেকে রাজধানীসহ সারা দেশে মাদক ছড়িয়ে পড়ছে।
সূত্র আরো জানায়, রেললাইনের দুপাশে ১০ ফুট জায়গা খালি রাখার নিয়ম রয়েছে। সরকারি নির্দেশনা ছাড়াও যে কোন দুর্ঘটনা এড়ানো ও বাড়তি সতর্কতার জন্য এমন বিধান। অথচ রাজধানীর মতো দেশের জেলা শহরগুলোর কোথাও এমন খালি রাখার চিত্র তেমন চোখে পড়ে না। ঢাকার নারায়ণগঞ্জ, গে-ারিয়া, শ্যামপুর, জুরাইন, শাহজাহানপুর, মালিবাগ, মগবাজার, কারওয়ানবাজার, তেজগাঁও, নাখালপাড়াসহ উত্তরা ও টঙ্গীর বিভিন্ন অংশে রেললাইনের দু’ধারে বস্তি, দোকান, বাজার, ছাপড়া ঘর, রাজনৈতিক দল ও অঙ্গ সংগঠনের নামে-বেনামে পাকা ও আধা-পাকা স্থাপনা রয়েছে। তার বাইরে অনেক এলাকায় সরকারি-আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বাস-ট্রাকের স্ট্যান্ড বানিয়ে দখল করা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নারায়ণগঞ্জ থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার রেললাইনের দু’পাশের প্রায় ২শ একর জমি দখল করে নিয়েছে। কোথাও জাল দলিল ও কাগজপত্র তৈরি করে আবাসন কোম্পানির ভবনও তোলা হয়েছে। তাছাড়া বিমানবন্দর ও তেজগাঁও রেলস্টেশন এলাকায় ১৯ একর এবং নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের বাইরে ২৯ একর জমি বেদখল হয়ে গেছে। তাছাড়া ঢাকা ছাড়া চট্টগ্রামে রেলের ২১৫ থেকে ২৩০ একর জায়গা বেদখল হয়ে আছে। তার মধ্যে বিভিন্ন সরকারি-আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের দখলেই ১৫০ একর জমি। আর বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দখলে আছে ৭৩ একর জমি। পাকশীতে দখল করা জমির মধ্যে ২ হাজার ৫৮ একরই বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের দখলে। লালমনিরহাটে রেলের ৮৪১ একর জমি বিভিন্ন ব্যক্তির দখলে আছে। একইভাবে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেললাইনের দু’পাশের অনেক জায়গা দখল হয়ে গেছে। সিলেটের শায়েস্তাগঞ্জ, জামালপুরসহ বিভিন্ন স্থানেও একই অবস্থা। কোথাও মার্কেট আবার কোথাও বাড়ি-ঘর ও বস্তি বানিয়ে ওসব জায়গা দখল করা হয়েছে। অথচ লাখো কোটি টাকার এসব জমি উদ্ধারে রেল যেমন ব্যর্থ হচ্ছে, তেমিন বছরে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। ফলে লাগাতার লোকসানের মধ্যে পরে থাকলেও রেলের পক্ষে লাভের মুখ দেখা সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে রেল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১৯৭৬ সালে রেলওয়েতে পৃথকভাবে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তার কার্যালয় করা হলেও জনবল অনেক কম। যার কারণে রেলের সম্পদের ওপরে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া প্রতিনিয়ত দলীয় ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালীরা নানা অজুহাতে রেলের জায়গা লিজ নিয়ে দখলের চেষ্টা চালু রেখেছে। ১৯৬০ সালে ফুলবাড়িয়া থেকে রেলস্টেশন কমলাপুরে স্থানান্তরিত হওয়ার পরে সেখানকার বিপুল পরিমাণ জমি সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখল করে নেয়। তাছাড়া টঙ্গী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত অনেক জায়গা বেদখল হয়ে আছে। অনেক সময় উচ্ছেদ অভিযানও চালানো হয়েছে। কিন্তু পরে আবারো তা বেদখল হয়ে যায়। আগে সরকারি জায়গা দখল করার এত প্রবণতা না থাকলেও এখন তা বেড়েই চলছে। আর রেললাইনের পাশে থাকা বস্তিগুলো নিয়ে আদালতের একটি নিষেধাজ্ঞা থাকায় সেগুলো নিয়ে কিছু করা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে চলতি বছর ১১ মার্চ চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর সেগুনবাগান এলাকায় রেলওয়ের জমি দখল করে গড়ে তোলা ২২টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে করে প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে সেগুনবাগানের এফ-৪ বাংলো সংলগ্ন রেলওয়ের মালিকানাধীন জমিতে তৈরি সেমিপাকা ও টিন শেড ২২টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। ওই সময় দখলকৃত শূন্য দশমিক পনের একর সরকারি জমি উদ্ধার করা হয়। তবে নগরবিদরা মনে করেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর রেল, সড়ক ও নদীর অবৈধ দখলকৃত জমি উদ্ধারে গৃহীত বিশেষ কর্মসূচি শুরুর পর গত এক মাসে (ফেব্রুয়ারি-মার্চ) সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ১৮শ’ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে। তাতে সরকারি সংস্থাটি বেদখল হওয়া ২০০ কোটি টাকা মূল্যের জমিও উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। বর্তমানে দেশে চলমান নদীখেকোদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানের ন্যায় রেলের জায়গা অবৈধভাবে দখলদারদের বিরুদ্ধে জোড়ালো অভিযান চালানো জরুরি। তবে উচ্ছেদের সাথে দখলদারদের স্থায়ীভাবে প্রতিহত করা সম্ভব হবে।
এ প্রসঙ্গে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন জানান, রেল সেক্টরটি বর্তমানে অগোছালো অবস্থায় রয়েছে। রেলকে গুছিয়ে একটি সুন্দর অবস্থায় ফেরানোর আগে জমি উদ্ধারে গেলে কোন সুফল আসবে না। কারণ জমি দখলের সাথে শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত। প্রশাসন একদিক দিকে জমি উদ্ধার করলে প্রভাবশালীরা একদিন পরেই আবারো দখল শুরু করে। যে কারণে কার্যত কোন সুফল আসে না। রেলের বেদখল হওয়া জমি উদ্ধারে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে ইতোমধ্যে একটি বৈঠক করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। তাছাড়া উদ্ধারের কাজও অনেক ব্যয়বহুল। যার কারণে সব কিছু গুছিয়ে খুব শিগগিরই দখলকৃত জমি উদ্ধারে অভিযান শুরু করা হবে।
এফএন/এমআর