ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
দেশে প্রতিদিনই পরিবেশ দূষণ হচ্ছে, কিন্তু মামলা হচ্ছে না। আর মামলা না থাকার কারণে পরিবেশ আদালতগুলো এক রকম নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। বিশেষায়িত পরিবেশ আদালতে পলিথিন, শিল্পদূষণ, মাটি কাটা, বালি ভরাট, শব্দদূষণ তথা পরিবেশসংক্রান্ত নানা অপরাধের বিচার হওয়ার কথা। কিন্তু ওই আদালতে বিগত ২০১০ সালে পরিবেশবিষয়ক মামলা হয়েছে মাত্র ৬০টি। আর ২০১১ সালে ৩৩টি, ২০১২ সালে ২৪টি, ২০১৩ সালে ৯টি, ২০১৪ সালে ৯টি ও ২০১৫ সালে ৮টি মামলা হয়। তাছাড়া ওই আদালতে ২০১৬ সালে ৪টি ও ২০১৭ সালে ৬টি মামলা হয়েছে। আবার নদী দখল, কারখানার দূষণসহ ওই ধরনের বিভিন্ন মামলায় অধিকাংশ সময়ই সাক্ষী উপস্থিত না হওয়ায় অনেক মামলা নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় আদালতের কার্যক্রম চালু রাখতে বিভিন্ন ধরনের ফৌজদারি অপরাধ চেয়ে নিয়ে বিচারকাজ চালাচ্ছে পরিবেশ আদালত। ফলে সরকারের বিশেষায়িত পরিবেশ আদালত স্থাপনের উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে। পরিবেশ আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ধারাবাহিকভাবে দেশের পরিবেশ সূচকের অবনতি হচ্ছে। শব্দ, পানি, বায়ু- সব দূষণই ব্যাপক মাত্রায় ছাড়াচ্ছে। যদিও দূষণ কমাতে আইনের মাধ্যমে বিশেষায়িত আদালত গঠন করা হয়েছে। কিন্তু ওই আদালতে মামলা আসছে খুব কম। পাশাপাশি যে হারে মামলা আসছে, আরো ধীরগতিতে তার নিষ্পত্তি হচ্ছে। পরিবেশ আদালত আইন ২০১০ পাস হওয়ার পর বিগত ৯ বছরে ঢাকা পরিবেশ আদালতে মামলা হয়েছে ১৭২টি। আর পরিবেশসংক্রান্ত হাতেগোনা যে কয়টি মামলা ওই আদালতে দায়ের হয়েছে, সাক্ষী উপস্থিত না হওয়াসহ নানা কারণে তাও ঠিকমতো নিষ্পত্তি হচ্ছে না। ১৭২টি মামলার মধ্যে এখন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৮২টি। এমন পরিস্থিতিতে পরিবেশসংক্রান্ত মামলা না থাকায় ঢাকা পরিবেশ আদালতেচুরি, জমি দখল, চেক জালিয়াতির মতো বিভিন্ন ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার বিচার চলছে। অথচ বিগত ২০০০ সালে পরিবেশ আদালত আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বিশেষায়িত আদালত হিসেবে পরিবেশ আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০১০ সালে আগের আইনটি রহিত করে ‘পরিবেশ আদালত আইন’ নামে সম্পূর্ণ নতুন আরেকটি আইন প্রণয়ন করা হয়, যার আওতায় বর্তমানে আদালতটি পরিচালিত হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ব্যক্তিপর্যায়ে মামলার নিয়ম থাকলেও নিয়মতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতাসহ বিভিন্ন ধরনের জটিলতার কারণে মানুষ মামলা করতে চান না। কারণ মামলা করতে হলে প্রথমে সংশ্লিষ্ট থানায় জিডি করতে হয়। তারপর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ওই বিষয়ে একটি দরখাস্ত লিখতে হয়। তারপর ৯০ দিনের মধ্যে জেলা প্রশাসক দরখাস্ত আমলে নিয়ে কোনো কার্যক্রম না নিলে পরিবেশ আদালতে নালিশি মামলা করা যায়। তাছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ আদালত জরিমানার মাধ্যমে অনেক অভিযোগের নিষ্পত্তি করে। ফলে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত পরিবেশ আদালতগুলোয় পর্যাপ্ত মামলা আসে না। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর পরিচালিত অভিযানে দূষণকারী প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যে তারা আবার একই ধরনের অপরাধে জড়ায়। অন্যদিকে মামলা না হওয়ার কারণে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ দূষণ করেও যথাযথ শাস্তি পাচ্ছে না।
সূত্র আরো জানায়, পরিবেশ আইনের ৭ ধারা অনুযায়ী অভিযোগের ভিত্তিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নিজ ক্ষমতাবলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে তাৎক্ষণিকভাবে পরিবেশ দূষণ সম্পর্কিত তথ্য নিরূপণ করে জরিমানা আদায় করতে পারে। আর ওই ধারাটিকে পরিবর্তন বা সংশোধন করা হলে পরিবেশ আদালতকে সচল হয়ে উঠবে। কারণ পরিবেশ অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে জরিমানা করলেও তদন্তসাপেক্ষে মামলা দায়ের ও আদালতে পাঠায় না। যদি পরিবেশ আইনের ৭ ধারা অনুসারে বিচারকাজ চলে, তাহলে আদালত দেয়ার প্রয়োজন ছিল না।
এদিকে পরিবেশ এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, পরিবেশ দূষণ সংক্রান্ত অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শর্টকাটে জরিমানা করেই ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু পরিবেশ আদালতে মামলা হলে সেখানে শাস্তি বেশি হতো। দীর্ঘমেয়াদে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেলে প্রতিষ্ঠানগুলো দূষণ কম করতো। আর ভ্রাম্যমাণ আদালতে যে জরিমানা করা হয়, তার প্রায় ৯০ শতাংশই আপিলের পর টেকে না। সেক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ আদালত খুব বেশি ফলপ্রসূ হচ্ছে না। তার পরিবর্তে ভ্রাম্যমাণ আদালত যদি প্রসিকিউশন দিয়ে পরিবেশ আদালতে পাঠাতো, তাহলে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাওয়ার ফলে সাজাটাও বেশি হতো এবং দূষণও কমতো। তাছাড়া আইনের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। যে কেউ গিয়ে পরিবেশ আদালতে মামলা করতে পারে না। সেটা যদি সংশোধন করা হয়, তাহলে পরিবেশ আদালতে মামলা বাড়বে।
অন্যদিকে ঢাকার পরিবেশ আদালতের বিশেষ পিপির দায়িত্ব পালনকারী ফিরোজুর রহমান মন্টু জানান, পরিবেশসংক্রান্ত অপরাধে প্রায় শতভাগ মামলায়ই আসামি সাজাপ্রাপ্ত হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধান নয়। ওই কারণে যারা আইন লঙ্ঘন করে দূষণ করছে, তাদের পরিবেশ আদালতের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
এফএন/এমআর