পায়রা বন্দরে চলছে পণ্য খালাস, হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান

প্রথম পাতা » পায়রা বন্দর » পায়রা বন্দরে চলছে পণ্য খালাস, হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান
মঙ্গলবার ● ২ এপ্রিল ২০১৯


---

মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া থেকে॥
পায়রা সমুদ্র বন্দর এখন কর্মচঞ্চল মানুষের পদচারনায় মুখরিত। এখানে চলছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। দিনরাত চলছে উন্নয়ন কর্মের ধারা। বিরামহীন এ উন্নয়ন কর্মে স্থানীয় এবং দেশের বিভিন্ন স্থানের অন্তত হাজার মানুষ শামিল হয়েছেন। হয়েছে এখানকার হাইলা-কামলা শ্রেণির শত শত অদক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান। যেসব মৌসুমী কৃষিশ্রমিক থাকত বেকার তারা পেয়েছেন কর্মসংস্থান। প্রশিক্ষিত কর্মজীবী হয়েছেন বহুজন। পেয়েছেন প্রশিক্ষণ পরবর্তী সনদ। ২০১৩ সালের ১৯ নবেম্বর বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতের ছোঁয়ায় শুরু হয় পায়রা বন্দরে কর্মযজ্ঞের ধারা। চলবে ২০২৩ সাল পর্যন্ত। বর্তমানে পুর্ণাঙ্গ গভীর বন্দরে উন্নীতের এ ধারা বইছে। মাত্র সাড়ে পাঁচ বছর আগে সন্ধায় ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিমজ্জিত জনপদ, শিয়ালের ডাক ছাড়া কিছুই শোনা যেত না। রাতে তো দুরের কথা দিনেও পদচারনা ছিলনা কোন মানুষের। ফেলনা, নদীর পাশের বনজঙ্গলে ঘেরা কলাপাড়ার টিয়াখালীর এ জনপদ এখন পরিণত হয়েছে আলোকিত। ফ্ল্যাড লাইটের আলোর ঝলকানিতে চোখ কুচকে যায়। চায়ের পিয়াস মেটানোর সুযোগ ছিল না, সেখানে এখন কফির তেষ্টা মেটায় মানুষ। নিত্য পদচারনা থাকছে দেশি-বিদেশী বিনিয়োগকারীর। ফেলনা, অনাবাদি জমি পরিণত হয়েছে সোনার খনিতে। নদীর পাড়ে এখন চলে লাইটার জাহাজে পণ্য খালাশের কার্যক্রম।
আনুষ্ঠানিকভাবে পায়রা বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট। এরপর থেকে নৌপথে মূল চ্যানেলে পণ্যবাহী মাদার ভেসেল থেকে পণ্য খালাশ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ফি মাসে অন্তত পাঁচ থেকে তারও বেশি জাহাজের পণ্য খালাস চলে। কর্মব্যস্ত যেমন এ বন্দরের নৌ-পথ, তেমনি বন্দর এলাকার স্থলপথে চলছে উন্নয়ন কর্মের ধারা বইছে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকার অন্তত ৪০ কোটি টাকার রাজস্ব আয় করেছে এ বন্দর থেকে। আর বন্দর আয় করেছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। এখানে ২২ হাজার কোটি টাকার মধ্যমেয়াদী প্রকল্প ২০২১ সালের মধ্যে বাস্তবায়িত হবে। ১২টি কম্পোনেন্টের মাধ্যমে পায়রা বন্দরের বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন করা হবে। বন্দর পরিচালক ক্যাপ্টেন এম মুনিরুজ্জামান জানান, জমি অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সাধারনত ক্ষতিপুরন দেয়া হয়। আইনে কোথাও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে দক্ষতার উন্নয়নে প্রশিক্ষণের কথা বলা নেই। তারপরও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে এবং কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রথম দফার তিনটি ট্রেডের প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে। এরা অনেকে বন্দরে এখন কাজ করছেন। এখন আবার দ্বিতীয় দফার প্রশিক্ষণ চলছে। এ কারণে এখানকার যারা জমি দিয়েছেন তারা ভাগ্যবান বলে মনে করছেন এম মুনিরুজ্জামান।
প্রাথমিকভাবে ১৬ একর জমিতে পায়রা বন্দর প্রকল্প এলাকা নির্মাণ করা হয়। বন্দর চেয়ারম্যান কমডোর এম জাহাঙ্গীর আলম জানান, ইতোমধ্যে ভূমি উন্নয়ন কাজ সমাপ্ত করে সেখানে প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে পানি শোধনাগার, যেখান থেকে দৈনিক দুই হাজার টন নিরাপদ পানি সরবরাহ করা যাচ্ছে। কাস্টমসসহ নিরাপত্তা ভবন নির্মিত হয়েছে আগেই। স্থাপিত হয়েছে লাইটার জাহাজ থেকে পণ্য খালাশের টার্মিনাল। সার্ভিস জেটির নির্মাণ কাজ শেষের পথে। বেইলিব্রিজসহ সংযোগ সড়ক নির্মিত হয়েছে। সোলার বাতিসহ বিদ্যুত সরবরাহ চালু করা হয়েছে। সাবমেরিন কেবল লাইন টানা হয়েছে। সাগর মোহনা থেকে মূল চ্যানেলের নেভিগেশনাল বয়া স্থাপন করা হয়েছে। স্থাপিত হয়েছে সীগনাল বাতি। সাগর থেকে চ্যানেলের ইনার সাইটে ২৮টি বয়াবাতি সেট করা হয়েছে। রামনাবাদ থেকে তেতুলিয়া নদীতে বরিশাল হয়ে ঢাকার মেঘনা নদীর হিজলা পর্যন্ত ৭০ মাইল নদী খনন করা হয়েছে। যেখানে পাঁচ মিটার নাব্যতা বজায় রাখা হয়েছে। এ চ্যানেলেও ৪৬টি বয়াবাতি স্থাপন করা হয়েছে। গোটা চ্যানেলটিতে ১০ মিটার নাব্যতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে খনন চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। পাঁচতলা মূল প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ৪২ হাজার বর্গফুট কয়েল হাউস এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। শেষের পথে পায়রা বন্দরের সঙ্গে মহাসড়কের সরাসরি যোগাযোগে পাঁচ দশমিক ৬০ কিমি দীর্ঘ ফোরলেন শেখ হাসিনা সড়কের নির্মাণ কাজ। এজন্য ২৫৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা ব্যয়-বরাদ্দ রয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে বালুর পাইলিংএর উপর কংক্রিটে নির্মাণ হচ্ছে এ সড়কটি। বন্দর সংলগ্ন ট্রাক স্টান্ডের জন্য প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহন করা হয়েছে। বন্দর সার্ভিস সুবিধার জন্য বিভিন্ন ধরনের জলযান (হাই-স্পিড) নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। বন্দর প্রকল্প এলাকার বাউন্ডারি দেয়াল নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সংক্ষিপ্ত পরিসরে চলছে সিএন্ডএফ এজেন্ট ক্লিয়ারেন্স এবং ইমিগ্রশনের কাজ। ইতোমধ্যে অর্ধশতাধিক বিদেশী নাগরিকের ইমিগ্রেশন সুবিধা দেয়া হয়েছে এ বন্দর থেকে।
পায়রা বন্দর চালু হওয়ায় এখানকার মৌসুমী কৃষি শ্রমিকসহ জেলে পরিবারের অদক্ষ শ্রমিকরা পেয়েছেন কর্মসংস্থান। অন্তত পাঁচ শ’ অদক্ষ শ্রমিক পায়রা বন্দরের কর্মযজ্ঞে শামিল হয়েছেন। স্থানীয় কেউ কেউ পেয়েছেন গাড়ি চালকসহ নিরাপত্তার চাকরি। বিকল্প জীবিকার পথ পেয়ে এ মানুষগুলো স্বস্তিতে রয়েছেন। প্রশিক্ষণ শেষে প্রায় ১৫জন এখন প্রশিক্ষিত রাজমিস্ত্রি হিসেবে বন্দরে কাজ করছেন।
বন্দর সুত্রে জানা গেছে, এ বন্দর ব্যবস্থা পূর্নাঙ্গভাবে গড়ে তোলার জন্য তিনটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে। প্রথমতঃ বন্দরের বহির্নোঙ্গরে ক্লিংকার, সার ও অন্যান্য বাল্ক পণ্যবাহী জাহাজ আনয়ন ও লাইটার জাহাজের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে পরিবহন করে স্বল্প পরিসরে কার্যক্রম শুরু করা। দ্বিতীয়তঃ পায়রা বন্দরে অন্তত একটি কন্টেইনার টার্মিনাল ও একটি বাল্ক টার্মিনাল প্রস্তুত করা। যা শেষ পর্যায় রয়েছে। তৃতীয়তঃ ধাপে ধাপে (২০২৩ সাল) বন্দরের অন্যান্য আনুষঙ্গিক পূর্ণাঙ্গ সুবিধা গড়ে তোলা।
বন্দরের সার্বিক কার্যক্রম বিভিন্ন কম্পোনেন্টে ভাগ করা হয়েছে। যার রয়েছে জি টু জি ও ছয়টি ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট এর মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। এছাড়াও বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রমের জন্য ইতোমধ্যে বন্দরের কারিগরী ও অর্থনৈতিক সমীক্ষা, পায়রা বন্দর প্রকল্প ভূমি অধিগ্রহণ আইন-২০১৫, ৭২ নটিক্যাল নৌ-পথ জরীপ, পোর্ট রেডিও কন্ট্রোল স্টেশন স্থাপন, এক হাজার কেভিএ বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন নির্মাণ, নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতকরন, ইউএন লোকেটর কোড, আইএসপিএস কোড, পিওএমএমডি কর্তৃক নৌ বাণিজ্য ছাড়পত্র, শুল্কায়ন, ইমিগ্রেশন সার্ভিস, কোয়ারেন্টাইন, পোর্ট হেল্থ, শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর নিয়োগ, সিএন্ডএফ ও এজেন্সী সার্ভিস, ট্যারিফ নির্ধারণ, ওয়েব সাইট, জাহাজের রাজস্ব ও শুল্ক পরিশোধ সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।
পূর্ণাঙ্গভাবে বন্দরের কার্যক্রম চালু করতে ইতোমধ্যে ওয়্যার হউস নির্মাণ, রামনাবাদ চ্যানেল থেকে কালীগঞ্জ নৌপথের বিভিন্ন স্পটে ড্রেজিং, প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ, হাইস্পিড, পাইলট ও টাগবোট সংগ্রহ, বয়া লেয়িং ভ্যাসেল, সার্ভে ভ্যাসেল, সার্ভিস পন্টুন স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। পরিকল্পনা চলছে সেতু নির্মাণ। এছাড়া প্রায় সাত হাজার একর জমি অধিগ্রহণের প্রাথমিক কাজও শেষ পর্যায়। পাশাপাশি এসব জমির মালিকদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে।
চট্টগ্রামের কুতুবদিয়ার আদলে দক্ষিণাঞ্চলের সিমেন্ট, ক্লিঙ্কার, গম, সারসহ বিভিন্ন মালামাল খালাশ কার্যক্রম বর্তমানে পুরোদমে চালু রয়েছে। ফলে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে পণ্যজটের চাপ বহুলাংশে লাঘব হবে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। শুধু তাই নয় চট্টগ্রাম ও মংলায় নাব্যতা সঙ্কটের কারণে জোয়ার-ভাটার ওপর অনেক সময় নির্ভরশীল থাকতে হয় পণ্য খালাশে। কিন্তু পায়রা বন্দরে পণ্য খালাশে নাব্যতা সঙ্কট নেই। জোয়ার-ভাটা ২৪ ঘন্টা পণ্য খালাশের সুযোগ রয়েছে। আর চারিপাড়ায় গভীরতা এতো বেশি যে সরাসরি মাদার ভ্যাসেল থেকে জেটিতে পণ্য খালাশের সুযোগ রয়েছে। এছাড়া চিটাগংএর চেয়ে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ দুরত্ব অনেক কম। পরিবহনখাতে ব্যয় কম হবে এ বন্দর ব্যবহার করে। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হলে পায়রা বন্দর হতে যাচ্ছে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ বন্দর। পায়রা বন্দর এলাকায় নিরাপত্তার কোন শঙ্কা নেই। কারণ এখানে দেশের সর্ববৃহৎ শের-ই-বাংলা নৌঘাটি নির্মিত হচ্ছে। নৌপথ থাকছে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তায়। ইতোমধ্যে বিভিন্ন ক্লিয়ারিং এন্ড ফরোয়ার্ডিং এজেন্সী তাদের ব্যবসার সম্প্রসার ঘটাতে জায়গা-জমি কিনেছেন। গড়ে উঠেছে একাধিক শ্রমিক সংগঠন। মোট কথা পায়রা বন্দরকে ঘিরে সাগরপাড়ের কলাপাড়া অঞ্চলের মানুষের মাঝে এক ধরনের উচ্চাকাঙ্খা তৈরি হয়েছে। যেন প্রত্যাশার সঙ্গে মানুষ প্রাপ্তির যোগসুত্র খুঁজে পেয়েছে। দেখছেন এর বাস্তব প্রতিফলন। আর প্রতিনিয়ত লগ্নিকারকরা জায়গা খুজছে আলোকিত পায়রায়।

বাংলাদেশ সময়: ২০:০৩:০৬ ● ১৪০২ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ