সাগরকন্যা এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট॥
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে বাংলাদেশী শ্রমিকদের শ্রমবাজার। পাশাপাশি নতুন শ্রমবাজারের সন্ধান মিলছে না। বন্ধ হয়ে রয়েছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। মধ্যপ্রাচ্যের পুরনো শ্রমবাজারে বিগত ২০১৭ সালের তুলনায় গতবছর কর্মসংস্থান প্রায় অর্ধেক কমেছে। চলতি বছরের প্রথম দু’মাসেও ওই ধারা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় নানা উদ্যোগের কথা বললেও নতুন কোনো শ্রমবাজার উন্মুক্ত হচ্ছে না। ইউরোপ, রাশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশগুলোয় কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গত দু’বছর ধরে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কথা বলছে মন্ত্রণালয়। কিন্তু জাপানে হাতে গোনা কর্মী পাঠানো ছাড়া বাংলাদেশিদের জন্যঅন্য কোথাও শ্রমবাজার খোলেনি। এমন পরিস্থিতিতে পর্যবেক্ষকরা শ্রম কূটনীতি জোরদার করার কথা বলছেন। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যানুযায়ী ২০১৮ সালে বিদেশে কাজ নিয়ে দেশ ছেড়েছেন ৭ লাখ ৩৪ হাজার ১৮১ বাংলাদেশি কর্মী। ২০১৭ সালে বিদেশ গেছে ১০ লাখ আট হাজার ৫২৫ জন। আগের বছরের তুলনায় গতবছর বিদেশে কর্মসংস্থান প্রায় ২৭ শতাংশ কম হয়েছে। আর চলতি ২০১৯ সালের প্রথম দু’মাসে বিদেশ গেছে এক লাখ ৯ হাজার ৬০৭ জন। তবে তাদের অর্ধেক ৫৪ হাজার ৮০৭ জনই গেছে সৌদি আরবে। অন্যদের গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমান, কাতার ও জর্ডান। আর চলতি বছরের প্রথম দু’মাসে জাপান গেছে ২৬ বাংলাদেশী কর্মী। কিন্তু একজন বাংলাদেশিরও ইউরোপের দেশ যুক্তরাজ্য ও ইতালিতে কর্মসংস্থান হয়নি। বিগত ২০১৮ সালেও একই চিত্র ছিল। গতবছর বাংলাদেশি কর্মীদের প্রায় ৯০ শতাংশেরই গন্তব্য ছিল সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ওমান, বাহরাইন, জর্ডান ও ইরাক।
সূত্র জানায়, জ্বালানি তেলের দরপতনে মধ্যপ্রাচ্যে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। গতবছরের শুরু থেকেই বাংলাদেশের প্রধান শ্রমবাজার সৌদি আরবে জনশক্তি রফতানিতে ভাটা শুরু হয়। ২০১৭ সালে ৫ লাখ ৫১ হাজার বাংলাদেশি কর্মী দেশটিতে গিয়েছিলো। ২০১৮ সালে সৌদি আরব গেছে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৩১৭ জন। সৌদি আরবে জনশক্তি রফতানি অর্ধেকের বেশি কমে গেছে। গতবছর মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশেই ২০১৭ সালের তুলনায় জনশক্তি রফতানি কমে গেছে। আরব আমিরাত ও বাহরাইনে কর্মী পাঠানো বন্ধের পথে। তবে আগের বছরের তুলনায় কমলেও কাতার ও ওমানের শ্রমবাজার অন্যান্য দেশের তুলনায় ২০১৮ সালেও স্থিতিশীল ছিল। ২০১৭ সালে ওমান যায় ৮৯ হাজার ৭২ কর্মী। গতবছর গেছে ৭২ হাজার ৫০৪ জন। ২০১৭ সালে কাতার যায় ৮২ হাজার ১২ জন। ২০১৮ সালে গেছে ৭৬ হাজার ৫৬০ জন। তবে গতবছর একমাত্র মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানি বেড়েছিল। ২০১৭ সালে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলো ৯৯ হাজার ৭৮৭ কর্মী। ২০১৮ সালে গেছে এক লাখ ৭৫ হাজার ৯২৭ জন। গতবছরের মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে ওসব কর্মী মালয়েশিয়ায় কাজ পেয়েছে। মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে সিন্ডিকেট ও দুর্নীতির কারণে উচ্চ অভিবাসন ব্যয়ে অন্তত ৫ হাজার কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে এমন অভিযোগে দেশটি জিটুজি প্লাস বাতিল করে। নভেম্বরের পর থেকে ওই পদ্ধতিতে কর্মী নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। মালয়েশিয়ার বাজার আবার কবে খুলবে তা অনিশ্চিত। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ২১ জন এবং ফেব্রুয়ারি মাসে মাত্র ১৪ কর্মী মালয়েশিয়া গেছে।
সূত্র আরো জানায়, সরকারের তরফ থেকে নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও উন্নত দেশগুলোর শ্রমবাজার বন্ধই রয়েছে। ২০১৮ সালে যুক্তরাজ্য গেছে মাত্র ৮ জন বাংলাদেশী কর্মী। জাপান গেছে ১৬৩ জন। ইতালি যেতে পারেনি একজনও। যদিও সাবেক প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির নেতৃত্বে শ্রমবাজার সম্প্রসারণে মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি দল৯টি দেশ সফর করে। কিন্তু নতুন বাজার পাওয়া যায়নি। রাশিয়া ও জাপানে বড় সংখ্যায় কর্মী পাঠানোর ঘোষণা দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। তাছাড়া ভারত মহাসাগরের ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র সেশেলস প্রতিনিধি দল সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে। পর্যটন শিল্পনির্ভর দেশটি বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়ার আগ্রহের কথা জানালেও কবে নাগাদ কর্মী পাঠানো যাবে তা এখনো নিশ্চিত নয়।
এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের গবেষণার তথ্যানুযায়ী ২০১৭ সালে ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর চাকরিজীবীদের মধ্যে ১ কোটি ৭০ ছিল প্রবাসী কর্মী। যার একটি বড় অংশ ভারত, চীন ও মেক্সিকোর হলেও বাংলাদেশ স্থান করে নিতে পারেনি। সরকারি হিসাবেই ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশ যাওয়া ৩৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ কর্মী ছিল অদক্ষ। আর সরকারি হিসাবে ৪৩ দশমিক ২৪ শতাংশ দক্ষ কর্মী বিদেশে গেছে। তবে জনশক্তি খাত সংশ্নিষ্ট অনেকে এ সংখ্যাকে শুভঙ্করের ফাঁকি বলছে। তাদেও মতে, যাদের দক্ষ বলা হচ্ছে তাদের অধিকাংশ সার্টিফিকেটধারী দক্ষ।
অন্যদিকে জনশক্তি খাত-সংশ্নিষ্টদের মতে, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসের উদ্যোগের ঘাটতিতেই বাংলাদেশীদের জন্য নতুন শ্রমবাজার উন্মুক্ত হচ্ছে না। কয়েক যুগের পুরনো নীতিতে এ খাত চলছে। রফতানিকারকরা যেসব দেশের চাহিদাপত্র আনতে পারে, শুধু সেখানেই বাংলাদেশ কর্মী পাঠাতে পারে। বাংলাদেশি কর্মীদের প্রায় ৯৫ শতাংশ এমন সব দেশে যায় যেগুলোতে শ্রম আইন দুর্বল ও বিদেশি শ্রমিকদের ওপর নিপীড়ন সাধারণ ঘটনা। দক্ষতার ঘাটতি থাকায় পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশে বাংলাদেশ কর্মী পাঠাতে পারে না।
এ প্রসঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব বদরুল আরেফীন জানান, কোন দেশে কত সংখ্যক কর্মীর চাহিদা রয়েছে, কীভাবে সেখানে বাংলাদেশি কর্মীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়- মন্ত্রণালয় সেই চেষ্টা করে। এ প্রচেষ্টা মন্ত্রণালয়ের সবসময়ই রয়েছে।