সাগরকন্যা এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট॥
রেলপথ উন্নয়নে নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও জনবল সঙ্কটে রেলের সেবার মান রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। বরং জনবলের অভাবে রেলের অপারেশনাল কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ইতিমধ্যে জনবল সঙ্কটে রেলের চার অঞ্চলে বিভক্তি মাঝপথে আটকে গেছে। রেলওয়ের দুটি অঞ্চল ও চারটি পরিচালন বিভাগকে ভেঙে ৪টি অঞ্চল ও ৮টি পরিচালন বিভাগ করা হবে। সেগুলো পরিচালনার জন্য বিদ্যমান শূন্য পদ পূরণ করার পরও আরো ১৭ হাজার ৩১২ জন জনবল দরকার। এমতাবস্থায় রেলওয়েকে চার অঞ্চলে বিভক্ত করা নিয়ে সঙ্কট দেখা দিয়েছে। রেলপথ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রেলের জন্য চলতি মাসেই নতুন কোচ আসছে। সেগুলো দিয়ে নতুন ট্রেন পরিচালনা করতে গেলে জনবল দরকার। কিন্তু রেলের বিদ্যমান জনবল সঙ্কট না কাটানো পর্যন্ত কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন না। বর্তমানে রেলওয়েতে সাড়ে ১৫ হাজারের বেশি পদ শূন্য রয়েছে। যা জনবলের প্রায় ৩৯ শতাংশ। উচ্চ আদালতে মামলার কারণে গত কয়েক বছরে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে, এমনকি লিখিত-মৌখিক পরীক্ষার পরেও বিভিন্ন পদে লোকবল নিয়োগ দিতে পারেনি রেলওয়ে। অথচ ইতিমধ্যে অবসরে গেছেন অনেক কর্মী। বেড়েছে ট্রেন, স্টেশনের সংখ্যা এবং রেলপথের দৈর্ঘ্য। এমন পরিস্থিতিতে জনবল সংকটে সেবার মান নিয়ে জটিলতার মুখে পড়েছে রেলওয়ে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে রেলওয়ের অনুমোদিত পদ রয়েছে ৪০ হাজার ২৭৫টি। তার বিপরীতে কর্মরত আছে ২৪ হাজার ৬২২ জন। অর্থাৎ ১৫ হাজার ৬৫৩টি পদ শূন্য। তবে শূন্যপদ পূরণে মাত্র ২ হাজার ৪৯৩ জনের নিয়োগ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। গত কয়েকদিন আগে দেয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পদ ধরলে শূন্যপদ পূরণে ওই সংখ্যা আরো ৫-৬শ বাড়তে পারে। বর্তমানে রেলওয়েতে প্রথম শ্রেণির পদ রয়েছে ৫৬৩টি। তার মধ্যে কর্মরত রয়েছে ৪০৮ জন। অর্থাৎ ১৫৫টি পদ শূন্য। দ্বিতীয় শ্রেণির পদ শূন্য রয়েছে ৬৯৮টি বা ৪৪ শতাংশ। বর্তমানে এক হাজার ৫৮৭টি দ্বিতীয় শ্রেণির পদের মধ্যে কর্মরত রয়েছে ৮৮৯ জন। আর রেলে তৃতীয় শ্রেণিতে সবচেয়ে বেশি শূন্য পদ রয়েছে। ওই শ্রেণির অনুমোদিত পদ রয়েছে ২১ হাজার ৬৪৪টি। তার বিপরীতে কর্মরত রয়েছে ১২ হাজার ৬০৩ জন। শূন্য রয়েছে ৯ হাজার ৪১টি পদ। তাছাড়া চতুর্থ শ্রেণির পদ শূন্য রয়েছে ৫ হাজার ৭৫৯টি। চতুর্থ শ্রেণিতে পদ রয়েছে ১৬ হাজার ৪৮১টি। কর্মরত রয়েছে ১০ হাজার ৭২২ জন।
সূত্র আরো জানায়, জনবল সংকটের কারণে সারা দেশে রেলের ৪৩৭টি স্টেশনের মধ্যে এখনো ১৩৯টি বন্ধ। তার মধ্যে পূর্বাঞ্চলে বন্ধ রয়েছে ৫৬টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ৮৩টি। তাছাড়া সারা দেশে রেলের এক হাজার ৪০২টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে ৯৪৬টিতে কোনো গেটকিপার নেই। তার মধ্যে পূর্বাঞ্চলে গেটকিপারবিহীন অরক্ষিত ক্রসিং রয়েছে ৪৩৪টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ৯৬৮টি। তাছাড়া রেলের ট্রাফিক বিভাগে বর্তমানে লোকবলের চরম সংকট রয়েছে। নতুন ট্রেন পরিচালনার জন্য তা অপারেশন বিভাগের কাছে ন্যস্ত করা হয়। জনবল সংকটে তখন অপারেশন বিভাগকে অনেক কষ্ট করে কাজ করতে হয়। অপারেশনাল কাজ চালাতে গিয়ে কোনো কোনো স্টেশনে তিন শিফটে কাজ করতে হচ্ছে। মূলত দীর্ঘদিন নিয়োগ না হওয়ায় রেলে বড় ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। যদিও ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে ১১ হাজার ৭৯০ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তা না হলে ট্রেন পরিচালনা করাই কষ্টকর হয়ে পড়তো।
এদিকে বিগত ২০১৪ সালের অক্টোবর রেলপথ মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রী রেলওয়েকে চারটি অঞ্চলে বিভক্ত করার নির্দেশ দেন। সেজন্য পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। রেলওয়েকে চার অঞ্চলে ভাগ করে পরিচালনার জন্য ওই পরামর্শক ৫৭ হাজার ৫৮৭ জনের সাংগঠনিক কাঠামোর প্রয়োজন বলে সুপারিশ করে। তাছাড়া রেলওয়ে সংস্কার প্রকল্পের আওতায় রেলওয়ের বিদ্যমান জনবলকে ৫০ হাজার ২৭৫ জনে উন্নীত করার সুপারিশ করা হয়। তার আগে বিএনপি সরকারের আমলে বেশকিছু স্টেশন বন্ধ করে দেয়া। ছাঁটাই করা হয় জনবল। ওই ছাঁটাইয়ের পর থেকেই গেটকিপার ছাড়াই লেভেল ক্রসিং দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করছে ট্রেন।
অন্যদিকে রেলওয়ের চার অঞ্চলের মধ্যে বর্তমান পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের হেড কোয়ার্টার চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতেই থাকবে। তবে পূর্বাঞ্চলের অধীনে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ হবে। পশ্চিমাঞ্চলের অধীনে থাকবে পাকশী ও লালমনিরহাট। তার বাইরে ময়মনসিংহ ও ঢাকা পরিচালন বিভাগকে নিয়ে গঠন করা হবে উত্তরাঞ্চল, যার হেডকোয়ার্টার হবে ময়মনসিংহ। রাজবাড়ী ও খুলনা বিভাগ নিয়ে গঠন করা হবে দক্ষিণাঞ্চল, যার হেডকোয়ার্টার হবে ফরিদপুরে। তবে রেলওয়েকে চার অঞ্চলে বিভক্ত হলে ভূসম্পত্তি বিভাগ, স্টোর বিভাগ ও রেলওয়ে নিরাপত্তা বিভাগে ব্যাপক চাপ তৈরি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। কারণ ওসব ক্ষেত্রেও নতুন জনবল ছাড়া চার অঞ্চলের অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব নয়।
এ প্রসঙ্গে রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন জানান, ইতোমধ্যেই রেলের জন্য নতুন জনবল চাওয়া হয়েছে। নতুন কোচ আসছে। সেগুলো দিয়ে নতুন ট্রেন চালাতে গেলে জনবল লাগবে। ৯৮টি পদের বিপরীতে এক লাখের উপর দরখাস্ত জমা পড়েছে। সেগুলো বাছাই করার জন্য অনেক সময় দরকার। তবে পর্যায়ক্রমে সব শূন্যপদেই জনবল নিয়োগ দেয়া হবে। নিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতে মামলাজনিত সমস্যা অনেকটাই কেটে গেছে। ফলে দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা ওয়েম্যান পদে শিগগিরি নিয়োগ চূড়ান্ত করা হবে। তাছাড়া রেলের পরিচালন বিভাগ উন্নীতকরণ নির্ভর করছে দক্ষিণাঞ্চলে নতুন রেলপথ চালুর উপর। পদ্মা সেতুর সাথে রেল সংযোগ চালুর পর রেলের পরিসর বাড়বে। তখন কাজের সুবিধার্থে রেলের আঞ্চলিক ও বিভাগীয় অফিস বাড়ানো হবে।