নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে দেনার বোঝা টানতে গিয়ে কাহিল অবস্থায় বিমান

প্রথম পাতা » বিশেষ প্রতিবেদন » নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে দেনার বোঝা টানতে গিয়ে কাহিল অবস্থায় বিমান
বুধবার ● ২৭ মার্চ ২০১৯


---

সাগরকন্যা এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট॥
রাষ্ট্রায়াত্ত উড়োজাহাজ সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বিগত ২০০৭ সালে দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক থেকে ২৯০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১৯ কোটি টাকায়। তাছাড়া  এখনো পরিশোধ করা হয়নি ১৯৮৪ সালে ডিসি-১০ কেনার ঋণের ২২২ কোটি টাকা। পাশাপাশি গত ১০ বছরে বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যাংক থেকে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে বিমান। এখনো ১০ হাজার ৪০০ কোটি টাকার ঋণ বকেয়া রয়েছে। এর মধ্যে ফ্লাইট পরিচালনা বাবদ বিমানের কাছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পাওনা এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা। আর বাকিতে তেল দেয়া পদ্মা অয়েল পাবে এক হাজার ৯০ কোটি টাকা। বকেয়া কর, যন্ত্রাংশ আমদানি ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং বিল বাবদ সরকারের কাছে বিমানের দেনা ২ হাজার কোটি টাকার বেশিও। এমন বিশাল দেনার বোঝা টানতে গিয়ে তীব্র নগদ অর্থের সংকটে পড়েছে বিমান। আর ওই সংকট কাটাতে লন্ডনের সোনালী ব্যাংক এক্সচেঞ্জ থেকে বিমান নতুন করে ২০ কোটি ডলার ঋণ নেয়ার চেষ্টা করছে। পাশাপাশি নিয়মিত কার্যক্রম চালু রাখতে ভাঙতে হচ্ছে এফডিআর। বাংলাদেশ বিমান সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশ বিমানকে লাভজনক করতে বিগত ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বিশ্বব্যাংক থেকে ৪০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে বিমানকে পাবলিক লিমিটেড কম্পানি করে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে প্রায় এক হাজার ৯০০ কর্মী কমানো হয়। আগে ২৯টি আন্তর্জাতিক রুটে চলাচল করলেও বিমান এখন ১৫টি রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। কিন্তু প্রায়ই বাংলাদেশ বিমানের টিকিট পাওয়া যায় না। এমনকি অনলাইনেও টিকিট পাওয়া যায় না। অথচ বাস্তবে বিমানের আসন খালি যায়। বিমানের কর্মকর্তারা কমিশন নিয়ে ওসব কাজ করে বলে দুদক সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। তাছাড়া মানসম্মত যাত্রীসেবা ও সঠিক বাণিজ্যিক কৌশলের অভাব, সময়মতো গন্তব্যে যেতে না পারা, ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা, বিমানের ভেতরে বাইরের নানা সিন্ডিকেটের দুর্নীতি ও অবচয়ের কারণে বছরের পর বছর রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান সংস্থাটি লোকসানের ঘানি টানছে। এখন ঋণের ভারে জর্জরিত বিমানের পরিচালনার ঝুঁকির পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে।
সূত্র জানায়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী সম্প্রতি জাতীয় সংসদকে জানিয়েছেন, গত অর্থবছরে (২০১৭-১৮) বিমান ২০১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা লোকসান করেছে। আর গত অর্থবছরে বিমান ৪ হাজার ৯৩১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা আয় করেছে। বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ১৩৩ কোটি ১২ লাখ টাকা। তবে আগের দুই অর্থবছরে বিমান মুনাফা করে বলে সংসদে জানানো হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিমানের আয় হয় ৪ হাজার ৫৫১ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ব্যয় হয় ৪ হাজার ৫০৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। ওই হিসাবে ওই অর্থবছরে ৪৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা লাভ হয়। তার আগের অর্থবছর ২০১৫-১৬ সালে বিমানের লাভ হয় ২৭৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। তবে বিমান সংশ্লিষ্ট অনেকেই সংস্থাটির আগের মুনাফার হিসাবকে আজগুবি বলছেন। তাদের মতে, বিমানের মুনাফা কাগজে-কলমে দেখানো হলেও বাস্তবে সত্য নয়। বিমানের বকেয়া চার্জ এবং তেলের মূল্য পরিশোধ করলে মুনাফা তো দূরের কথা, লোকসান দেখাতে হবে। মূলত বহুমুখী দুর্নীতির কারণেই লাভের মুখ দেখছে না বিমান। আর বিমানকে যদি দুর্নীতিমুক্ত করে ভালো যাত্রীসেবা দিতে না পারা যায়, তাহলে ওই প্রতিষ্ঠান কখনোই ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
সূত্র আরো জানায়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইট বিলম্বিত হওয়ার বিষয়টি রীতিমতো কুখ্যাত। ২০০৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর টাইম ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে প্রথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিমানসেবা হিসেবে বিমানের নাম উল্লেখ করা হয়। লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশী বিমান সংস্থার প্রতিটি ফ্লাইট গড়ে ৩ ঘণ্টা দেরিতে পৌঁছে বলে জানায় টাইম। ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও বিমানের ওই ফ্লাইট ডিলে বদনাম আজও ঘোচেনি। পাশাপাশি একের পর এক কারিগরি ত্রুটিটসহ নানা কারণে অভ্যন্তরীণ রুটেও মাঝেমধ্যে ফ্লাইট দেরি বা বাতিল হচ্ছে। ওসব কারণে বিমানবন্দরে ক্ষুব্ধ যাত্রীদের সঙ্গে বিমান স্টাফদের বাগিবত-া নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত দেড় মাসে বিমানের বেশির ভাগ ফ্লাইট সময়সূচি অনুযায়ী পরিচালিত হয়নি। বহরে থাকা তিনটি ড্যাশ-৮ এজিকিউ, এজিডাব্লিউ ও এজিআরে প্রায় সময়ই কারিগরি ত্রুটি ধরা পড়ছে। দ্বিতীয় এজিডাব্লিউ উড়োজাহাজটি প্রায়ই টেকনিক্যাল সমস্যায় পড়ে ফ্লাইট শিডিউলে বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। অবশিষ্ট ড্যাশ-৮ এজিআর দিয়ে কোনো রকমে চলছে অভ্যন্তরীণ ৭টি রুটের ফ্লাইট। যে কারণে মাঝে মাঝেই অন্তত ৪/৫টি ফ্লাইট দেরি এমনকি বাতিলও হচ্ছে। বিমানের এ ব্যর্থতার সুযোগ নিচ্ছে বেসরকারি সংস্থাগুলো।
এদিকে দুদকের মতে বিমানকে ডোবাচ্ছে এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতি ও উড়োজাহাজ কেনাকাটায় দুর্নীতি এবং হজ মৌসুমে ও অন্যান্য কারণে পুকুরচুরিতে নাকাল হয়ে পড়েছে বিমান। যাত্রীরা অনেক সময় অতিরিক্ত ব্যাগেজ নিয়ে বিমানে ওঠে। সে ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যাগেজের জন্য যাত্রীর কাছ থেকে অতিরিক্ত চার্জ গ্রহণ করা হলেও তা মূল হিসাবে না দেখিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে বিমানের দুর্নীতি রোধে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও সরঞ্জাম ক্রয়ের তালিকা, কখন কেনা হয়েছে, কী দামে কেনা হয়েছে, কোন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কেনা হয়েছে, কত টাকা মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে- এসব রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দুর্নীতির পরিমাণ নির্ধারণের তাগিদ দিয়েছে দুদক। তাছাড়া বিমানের ট্রানজিট/লে-ওভার প্যাসেঞ্জারের হিসাব ম্যানুয়ালি সংরক্ষণ না করে সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে ডিজিটাইজ করা, কর্মী ও যাত্রীদের মধ্যে বাস্তবে কতজন হোটেল রুমে অবস্থান করে তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য একটি মনিটরিং টিমের মাধ্যমে আকস্মিক পরিদর্শনের ব্যবস্থার সুপারিশ করেছে দুদক। দুর্নীতি প্রতিরোধ সংস্থাটি বলছে, বিমানকে সর্বতোভাবে ই-টিকিটিং, ই-রিজার্ভেশনে পদ্ধতিতে যাওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া ফলস বুকিং বন্ধ করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। এজেন্টদের বুকিং কোটা এবং বুকিং সময় কমিয়ে অনলাইন টিকিটের প্রাপ্যতা বাড়াতেও বলেছে দুদক।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ উইং কমান্ডার (অব.) এ টি এম নজরুল ইসলাম জানান, অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো বিমানেও দুর্নীতি হয়, তা সবার জানা। তবে দুদকের উচিত কোথায় কারা দুর্নীতি করছে তাদের চিহ্নিত করা এবং দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে বাঁচানো।

বাংলাদেশ সময়: ১১:৫৪:৫৪ ● ৬১৮ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ