ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
তীব্র ডলার সঙ্কটে দেশের ব্যাংকগুলো সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বিদেশী ব্যাংকের অর্থ পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে। দিন দিন সময়মতো বিদেশী ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করা আরো কঠিন হয়ে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ এলসি ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে গুনতে হচ্ছে জরিমানা। এমন অবস্থায় বেসরকারী ব্যাংকগুলোতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আর তাতে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়ছে ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তারা। সময়মতো প্রয়োজনীয় পণ্য আনতে না পারায় তাদের ব্যবসায় খরচ বাড়ছে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকট নিরসনে ডলার বিক্রির পাশাপাশি বিলাস পণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করছে। একই সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে ডলারও ছাড়ছে। তবে তাতেও স্থিতিশীল হচ্ছে না বাজার। বরং বেড়েই চলেছে ডলারের দাম। আর কমছে টাকার মান। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ডলারের ব্যাপক চাহিদায় মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। আর তা কমিয়ে আনার চেষ্টায় বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার ছেড়েই চলেছে। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১৫৫ কোটি ডলার বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বিক্রি করেছে। কিন্তু তাতে খুব বেশি লাভ হচ্ছে না। ব্যাংকগুলো যে দরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে, গ্রাহকের কাছে বিক্রি করার সময় দাম নিচ্ছে আরো বেশি। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান গত এক বছরে ক্রমাগত কমছে। ফলে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স এবং রফতানি আয়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়লেও আমদানিতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির বিশ্লেষকদের মতে, আমদানি বাড়ার কারণে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু আমদানির তথ্যের আড়ালে বিদেশে অর্থ পাচারও এর একটি কারণ বলে কেউ কেউ মনে করছেন।
সূত্র জানায়, পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েস দেখানো দেশ থেকে অর্থ পাচারের একটি অন্যতম। অর্থাৎ যে দামে পণ্য কেনা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি দাম দেখিয়ে বাড়তি অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়। আবার কখনো কখনো যে পণ্য আমদানি হওয়ার কথা, তার বদলে কম দামি পণ্য আনা অথবা খালি কন্টেনার আনার ঘটনাও ধরা পড়েছে। পাশাপাশি পণ্য রফতানিতেও আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়। যে পণ্যের দাম ১০০ ডলার, ক্রেতার সঙ্গে বোঝাপড়া করে তা ৭০ ডলার দেখিয়ে রফতানি করা হয়। বাকি ৩০ ডলার ব্যবসায়ীরা বিদেশে ওই ক্রেতার কাছ থেকে নিয়ে তা বিদেশেই রেখে দিচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকগুলো যে দরে ডলার বা অন্য মুদ্রা কেনাবেচা করে তাকে আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বিনিময় হার বলা হয়। ব্যাংকগুলো তার চেয়ে এক থেকে দেড় টাকা বেশি দামে ডলার গ্রাহকের কাছে বিক্রি করে। বিগত এক বছরের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৫ শতাংশের বেশি। আর গত ৬ মাসের ব্যবধানে কমেছে প্রায় ৩ শতাংশ। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের সাড়ে ৬ মাসে (২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি) পর্যন্ত ১২৫ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অথচ গত অর্থবছরের ওই সময়ে বাজার স্থিতিশীল থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কোন ডলার বিক্রি করতে বা কিনতে হয়নি। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সময়মতো বিদেশী ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ফলে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে এলসি। ডলার সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে। চলতি অর্থবছরের (২০১৮-১৯) শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ১৫৫ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। আর ডলার বিক্রি করায় কমে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বর্তমানে রিজার্ভ কমে প্রায় ৩ হাজার ১০০ কোটি (৩১ বিলিয়ন) ডলার হয়ে গেছে। যেখানে গত বছর একই সময়ে ৩ হাজার ২২৭ কোটি (৩২ বিলিয়ন) ডলার ছিল। গত বছরের ২১ মে থেকে ডলার ৮৩ টাকা ৭০ পয়সায় স্থিতিশীল ছিল। পরে ২৮ জুন থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আন্তঃব্যাংক ডলারের মূল্য ছিল ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সা। এভাবে পর্যায়ক্রমে বাড়তে বাড়তে এখন ৮৪ টাকা ৪০ পয়সা হয়ে গেছে। আর আন্তঃব্যাংক লেনদেনের বাইরে কার্ব মার্কেটে (খোলা বাজারে) ডলারের দাম আরও বেশি।
এদিকে এ বিষয়ে বেসরকারী গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের মতে, আমদানি বাড়ার পাশাপাশি প্রচুর অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। আর দীর্ঘদিন ধরেই তা হয়ে আসছে। কোন কারণে অনিশ্চয়তা বাড়লে অর্থ পাচারের প্রবণতাও বাড়ে। মূলত তিন ভাগে বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে। প্রবাসীদের মাধ্যমে যে রেমিটেন্স দেশে আসার কথা সেটা না এসে তৃতীয় একটি পক্ষের মাধ্যমে তা কানাডা-আমেরিকায় চলে যাচ্ছে। যে রেমিটেন্স ব্যাংকিং চ্যানেলে এসে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হওয়ার কথা, তা দেশে না এসে বাইরেই থেকে যাচ্ছে।
অন্যদিকে ডলার সংকট বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান জানান, আগের বছরে ব্যাপকহারে আমদানি হওয়ায় এখন ডলার সংকট হচ্ছে। ওই সময়ে রফতানির চেয়ে আমদানি অনেক বেশি ছিল। তবে বর্তমানে রফতানির প্রবৃদ্ধি ভাল হচ্ছে। আমদানিও কমতে শুরু করেছে। আশা করা যায় শিগগিরই অবস্থার উন্নতি হবে। তবে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্রিয় থাকার কোন বিকল্প নেই।
ডলার সঙ্কট প্রসঙ্গে এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, রফতানি, রেমিটেন্স আয়ের সঙ্গে আমদানি ব্যয়ের একটা অসামঞ্জস্য হয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। ফলে দাম বেড়ে যাচ্ছে। আর চাহিদা অনুযায়ী ডলারও দিতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারিতে পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৬১২ কোটি ৮ লাখ ডলার। জানুয়ারি মাসে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ১৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
এফএন/এমআর