সাগরকন্যা ডেস্ক ॥
দেশে সরকারি চিনিকলগুলোতে উৎপাদন খরচ অস্বাভাবিক বেশি পড়ছে। প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে সর্বোচ্চ খরচ পড়ছে ৩শ’ টাকারও বেশি। অথচ প্রতিকেজি চিনি আমদানি করলে খরচ পড়ে মাত্র ৪৮ টাকা। আর অপরিশোধিত চিনি এনে দেশে শোধন করলে প্রতি কেজিতে ৪০ টাকার মতো খরচ পড়ে। এমন পরিস্থিতির কারণে দেশে সরকারি চিনিকল আছে ১৫টি মধ্যে ১৪টি লোকসান গুনছে। বাংলাদেশ খাদ্য ও চিনি শিল্প কর্পোরেশন সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে বর্তমানে চিনির চাহিদা আনুমানিক ১৫ লাখ টন। আর সরকারি ১৫টি চিনি মিলের সক্ষমতা ২ লাখ টন হলেও এবার তার বিপরীতে উত্পাদন করেছে মাত্র ৬৮ হাজার টন। যার মধ্যে বেশিরভাগই অবিক্রিত থাকে। ফলে বাংলাদেশ চিনি শিল্প কর্পোরেশন চিনি উৎপাদনের পাশাপাশি গতবছর ১ লাখ ৮ হাজার টন চিনি আমদানি করে। যার মধ্যে এখনো ৮৪ হাজার টন অবিক্রিত আছে। প্রতি কেজি চিনির আমদানি খরচ পড়েছে ৪৮ টাকা। আর বেসরকারি কোম্পানীগুলো প্রতিবছর গড়ে ১৪ লাখ টন চিনি অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে। সেগুলো আমদানির পর নিজস্ব মেশিনে পরিশোধন করে সাদা চিনি তৈরি করা হয়।
সূত্র জানায়, কুষ্টিয়া সুগার মিলে প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন খরচ ৩৩৪ টাকা। পাবনা সুগার মিলে ওই খরচ প্রায় ৩শ টাকা। তবে কোনো মিলেই উৎপাদন খরচ ১৩০ টাকার কম নয়। অথচ বাজারে প্রতি কেজি চিনির বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৫০ টাকায়। পাশাপাশি শুধুমাত্র আখের অভাবে বছরের বেশিরভাগ সময় সরকারি চিনি মিলের উৎপাদন বন্ধ থাকছে। ১২ মাসের মধ্যে কুষ্টিয়া সুগার মিল চলে মাত্র ২ মাস। আর আখের অভাবে বন্ধ হয়ে আছে জয়পুরহাট সুগার মিল। সরকারি চিনিকলগুলো রয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ খাদ্য ও চিনি শিল্প কর্পোরেশনের আওতায়।
সূত্র আরো জানায়, দেশে চিনির উৎপাদনের পর আখের উপজাতকে কাজে লাগাতে পারলে সরকারি মিলগুলো লাভজনক হতে পারতো। সরকারি চিনিকলগুলোর মধ্যে একমাত্র লাভের মুখ দেখছে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি। চিনি উৎপাদনের ক্ষেত্রে লোকসান করলেও কেরুর ডিস্টিলারি ইউনিটই লাভ করছে। ১৯৩৮ সালের প্রতিষ্ঠিত এই চিনি কলটিতে দেশি মদের পাশাপাশি ৯টি ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ বা ফরেন লিকার তৈরি হয়। আখ থেকে চিনি বের করে নেয়ার পর তিনটি উপজাত থাকে। মোলাসেস বা চিটাগুড়, ব্যাগাস বা ছোবড়া, প্রেসমাড বা গাদ। মোলাসেসই লিকার উৎপাদনের মূল উপকরণ। তাছাড়া ওই চিনিকলে তৈরি হয় দুই ধরণের ভিনেগার, স্পিরিট ও জৈব সার। গত অর্থবছরে কেরু এ্যান্ড কোম্পানী প্রায় ৮ কোটি টাকা লাভ করে। কিন্তু বাকি চিনিকলগুলো বছরের পর বছর লোকসান দিচ্ছে। ওই কলগুলোকে লাভজনক করার জন্য তেমন উদ্যোগ নেই।
এদিকে সরকারি চিনিকলগুলোকে কেরু অ্যান্ড কোম্পানির আদলে ব্যবহার করার কথা উঠলেও কর্পোরেশনের শীর্ষ কর্তারা তাতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তবে নর্থ বেঙ্গল ও ঠাকুরগাঁও চিনি কলে মদ, বিদ্যুৎ ও জৈব সার তৈরির প্রক্রিয়া চলছে। ওই দুটি চিনি কলে প্রায় ৮শ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হয়েছে। বর্তমানে চিনিকলগুলো লোকসানে থাকায় কর্মকর্তা কর্মচারি ও শ্রমিকদের ৩/৪ মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। বেতনের বদলে তাদের দেয়া হচ্ছে চিনি। ওই চিনি বিক্রি করেও পুরো বেতন নিতে পারছেন না তারা। পাশাপাশি আখচাষীরা এই কর্পোরেশনের কাছে পাবেন ৩৫০ কোটি টাকা। তার উপরে আছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণে বোঝা।
অন্যদিকে আখের বীজ রোপন থেকে শুরু করে কাটা পর্যন্ত ১২ থেকে ১৪ মাস সময় লেগে যায়। সারা বছর ধরে জমিতে একটি ফসলই পড়ে থাকে। অথচ ধান, ডাল ও সবজি চাষে কম সময় নেয়, লাভও বেশি। ওই কারণেই আখ চাষে কৃষকরা আগ্রহ হারাচ্ছে। কিন্তু আখের অভাবে চিনিকল বন্ধ থাকলেও শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে সারাবছরের বেতন-ভাতা দিতে হয়। ফলে সরকারি চিনিকলগুলোর লোকসানের পরিমাণও বাড়ছে।
সরকারি চিনিকলগুলোর লোকসান প্রসঙ্গে কুষ্টিয়া সুগার মিলে জেনারেল ম্যানেজার আবু সায়েম জানান, সুগার মিলগুলোর মেশিন দীর্ঘদিনের পুরনো হওয়ায় উৎপাদন কম। নিয়ম অনুযায়ী ১শ কেজি আখ থেকে সাড়ে ৭ কেজি চিনি পাওয়ার কথা। অথচ দেশের চিনি মিলগুলোতে পাওয়া যায় ৫ কেজিরও কম। পাশাপাশি ঋণের টাকা পরিশোধ করতে গিয়েও লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে। কোন চিনি কলের মোট ব্যয় ৫০ কোটি টাকা হলে সুদ পরিশোধ করতে হয় ২০ কোটি টাকা। ওই কারণে চিনির উৎপাদন খরচও বেড়ে যায়।
একই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ চিনি ডিলার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু জানান, প্রশাসনিক অদক্ষতায় চিনি কলগুলোতে লোকসান হয়।
এফএন/কেএস