সাগরকন্যা এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট॥
প্রতি বছরই দেশে আলুর উৎপাদন বাড়ছে। কিন্তু রফতানি না বেড়ে ক্রমেই তা কমছে। মানসম্মত জাতের অভাব, আলুর রোগ, পর্যাপ্ত এ্যাক্রেডিটেড ল্যাবরেটরি না থাকাসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে আলু রফতানি দিন দিন কমেই চলেছে। পাশাপাশি চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন, সংরক্ষণাগারের অভাব ও অতিরিক্ত রফতানি না হওয়ায় ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কৃষক। বাংলাদেশের দুটি বড় বাজার রাশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় ২০১৫ সাল থেকে আলু রফতানি বন্ধ রয়েছে। আলু রফতানির ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হচ্ছে জাতের অভাব। বিগত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এদেশষ থেকে আলু রফতানি হয় ১ লাখ দুই হাজার ৯৮৩ টন। সেটাই সর্বোচ্চ রফতানি। পরের বছর রফতানি কমে হয় ৯৪ হাজার ৬১৩ টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪০ হাজার ২২৯ টন আলু রফতানি হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আলু রফতানি হয় ৫৫ হাজার ৬৫২ টন। সর্বশেষ গত অর্থবছরে ৫২ হাজার টন আলু রফতানি হয়। কৃষি মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ আলু রফতানিকারক সমিতি (বিপিইএ) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে আলুর বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৭০ লাখ টনের মতো। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে আলুর উৎপাদন এক কোটি টনেরও বেশি। চলতি বছর চাষ করা আলু এখন পর্যন্ত ৬০ শতাংশ উত্তোলন করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে এ বছরও উৎপাদন এক কোটি টন ছাড়িয়ে যাবে। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যানুযায়ী এখন বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ১৫-২০ টাকায়। বর্তমানে দেশে ৩৬৩টি আলু সংরক্ষণাগারের ধারণক্ষমতা ৩০ লাখ টনের মতো। বিগত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪ লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর জমিতে ৯৪ লাখ ৫৪ হাজার টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। পরের বছর ৪ লাখ ৯৬ হাজার হেক্টর জমিতে চাষে উৎপাদিত আলুর পরিমাণ এক কোটি তিন লাখ টন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫ লাখ ২৮ হাজার হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদন হয় এক কোটি ১৩ লাখ ৩৩ হাজার টন। তবে গতবছর আলুর উৎপাদন কিছুটা কমে এক কোটি ৩ লাখ টনে দাঁড়ায়।
সূত্র জানায়, আলু একটি জনপ্রিয় কন্দাল জাতীয় ফসল। অনুকূল আবহাওয়া ও রাসায়নিক সার পর্যাপ্ত থাকায় প্রতি বছর দেশে আলুর উৎপাদন বাড়ছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ৩০টি জাতের আলুর চাষ হচ্ছে। ধান ও গমের পর বিশ্বে আলুই গুরুত্বপূর্ণ ও নেতৃস্থানীয় প্রধান ফসল। বিশ্বের ৪০টি উন্নত দেশের অন্যতম প্রধান খাদ্য হিসেবে আলু পরিচিত। কিন্তু আলু রফতানি বাড়াতে হলে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটকে অধিক পরিমাণে ড্রাইমেটার (শুকনো অংশ) সমৃদ্ধ আলুর জাত উদ্ভাবন করা জরুরি। কারণ এদেশ থেকে এখন শুধু গ্রানুলার জাতটি রফতানি হচ্ছে। কিন্তু ক্রমান্বয়ে বহির্বিশ্বে এর চাহিদা কমে যাচ্ছে। তাছাড়া এদেশে এখনো আলুভিত্তিক কোন প্রতিষ্ঠিত শিল্প গড়ে ওঠেনি। কোল্ড স্টোরেজ মালিকরা ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি আলু রাখেন। তাতে আলু পঁচে যায়। ফলে কোল্ড স্টোরেজে রাখা আলু রফতানি করলে ঝুঁকি থেকে যায়। কারণ তাতে আলুর কার্বোহাইড্রেড ভেঙ্গে সুগারে পরিণত হয়, ফলে মিষ্টি আলু আর রফতানি করা যায় না। তাছাড়া আলুর ব্ল্যাক হার্ট এবং হলো হার্ট রোগের কারণেও রফতানিতে সমস্যা হয়। পাশাপাশি বর্তমানে কৃষিপণ্য রফতানির ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু আলু রফতানিকারকরা নগদ সহায়তার পরিমাণ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন।
সূত্র আরো জানায়, আলু উৎপাদনকারীরা যদি কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে (কৃষকদের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে ফসল ফলানো) না যায় তবে আলু রফতানির ক্ষেত্রে অবস্থার তেমন উন্নতির সম্ভাবনা নেই। কোয়ালিটি নিশ্চিত করতে না পারলে কারওয়ানবাজার থেকে আলু কিনে বিদেশ রফতানি ধরে রাখা সম্ভব হবে না। কোয়ালিটি আলু নিশ্চিত করতে হলে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে যেতেই হবে। ইন্দোনেশিয়ার কৃষি মন্ত্রণালয় ২০১৫ সালে ওই দেশের ফ্রেস ফুড প্ল্যান্ট অরিজিন (এফএফপিও) আমদানি নিয়ন্ত্রণে কতিপয় বিধি-নিষেধ আরোপ করে। সেজন্য ইন্দোনেশিয়ার কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে ফুড সেফটি পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশের কৃষি মন্ত্রণালয়কে ল্যাবরেটরি রেজিস্ট্রেশনের আবেদন দাখিলের পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু ওই আবেদন এখনও পাঠানো হয়নি। ইন্দোনেশিয়ায় আলু রফতানির প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য প্রেস্টিসাইড রেসিডিউস, হেভি মেটাল, মাইকোটক্সিন ও মাইক্রোবায়োলজিক্যাল কন্টামিন্যান্টস পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। ওই ৪টি পরীক্ষার মধ্যে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ল্যাবরেটরিতে প্রেস্টিসাইড রেসিডিউস ও বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের ল্যাবরেটরিতে হেভি মেটাল পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে অন্য দুটি পরীক্ষার ব্যবস্থা এদেশে নেই। তাছাড়া আলুতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার (ব্রাউন ড্রাউট) অস্তিত্ব পাওয়ায় ২০১৫ সালে থেকে বাংলাদেশের আলু আমদানিতে সাময়িকভাবে নিষেধাজ্ঞারোপ করেছে রাশিয়া। ওই নিষেধাজ্ঞা এখনো উঠানো সম্ভব হয়নি।
এদিকে আলুর ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত ও রফতানি বাড়াতে এর আগে কৃষি বিপণন অধিদফতর মন্ত্রণালয়ের কাছে কিছু পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল- আলু উৎপাদন হয় এমন এলাকায় ব্যাপকভাবে হিমাগারের সংখ্যা বাড়ানো, সরকারিভাবে কৃষকদের কাছ থেকে আলু কিনে রাখা ও পরবর্তী সময় ভর্তুকি দিয়ে বিক্রি করা, আলু রফতানির সম্ভাবনার দিকটি আরো সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া। তাছাড়া ভিজিডি, ভিজিএফ, কাবিখার মতো উন্নয়ন কর্মসূচীতে আলু বিতরণ; আলু উৎপাদন হয় এমন এলাকায় ব্যাপকহারে গৃহপর্যায়ে বসতবাড়িতে স্বল্পব্যয়ে আলু সংরক্ষণাগার নির্মাণ; বেসরকারী পর্যায়ে আলু প্রক্রিয়াজাতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সরকারি সহায়তা বৃদ্ধি; নতুন বৈশিষ্ট্য সংবলিত উচ্চ ফলনশীল আলুর জাত উদ্ভাবন; উৎপাদন খরচের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আলুর ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণেরও সুপারিশ করেছিল কৃষি বিপণন অধিদফতর।
অন্যদিকে
বাংলাদেশ আলু রফতানিকারক সমিতির (বিপিইএ) সভাপতি শেখ আব্দুল কাদের জানান, আলু রফতানির ক্ষেত্রে আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে জাতের অভাব। প্রোডাক্ট ছাড়া তো ব্যবসা হয় না। আমাদের এক্সপোর্টেবল ভ্যারাইটি নেই। আমাদের এ্যাক্রেডিটেড ল্যাবরেটরির অভাব রয়েছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ সমস্যার কথা বলে আসছি। কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি, তবে বর্তমানে কিছু উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি। রাশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় আলু রফতানি খুলে দেয়ার জন্যও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কাজ করছেন।
এ বিষয়ে কৃষি সচিব মোঃ নাসিরুজ্জামান জানান, সরকার এ্যাক্রেডিটেড ল্যাবরেটরি তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে। আশা করা যায় তাতে রাশিয়া-ইন্দোনেশিয়াতে আলু রফতানির দুয়ার আবার খুলে যাবে। তাছাড়া বিদেশে আলু হয় ছয় মাসে আর এদেশে আলুটা উৎপাদন হয় ১২০ দিনের মধ্যে। সেক্ষেত্রে ড্রাইমেটারটা হলো বড় একটি বিষয়। পাশাপাশিঅতিরিক্ত উৎপাদন হওয়ায় কৃষকরা আলুর ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। আলুটা রফতানি করতে পারলে তা হতো না। সরকার কৃষককে আলুর পরিবর্তে অন্য লাভজনক ফসল উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করছে। রফতানি বাড়ানোর বিষয়গুলো নিয়েও সরকার চিন্তা করছে। তবে রফতানির বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারাধীন। তাছাড়া রফতানির ক্ষেত্রে আলুর ড্রাইমেটার ২৪ শতাংশ বা এর বেশি হতে হয়। কিন্তু এদেশের আলুর ড্রাইমেটার ২০ শতাংশের মধ্যে থাকে।