গৌরনদী (বরিশাল) সাগরকন্যা প্রতিনিধি॥
জেলা প্রশাসনের দেওযা ১৪টি শর্তের অধিকাংশই অমান্য করে বরিশালের গৌরনদীতে জামদানী মেলা’র নামে বাণিজ্য মেলা চলছে। গত ১৮ ডিসেম্বর গৌরনদী বন্দর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘেঁষা পৌরসভার বালুর মাঠে শুরু হওয়া এ মেলা দর্শনার্থী ও ক্রেতাদের ভিড়ে জমে উঠছে। পৌরসভাকে ইজারা ও সরকারকে কোন রাাজস্ব না দিয়েই অবৈধ ভাবে মেলায় স্টল বরাদ্দ দিয়ে ও টিকেট বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে মেলার আয়োজক কমিটির বিরুদ্ধে। ফলে অন্তর্বর্তীকালিন সরকার কয়েক লাখ টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
জানা গেছে, গৌরনদী থানা সংলগ্ন পৌরসভার বালুর মাঠে এক মাসব্যাপী ‘দেশীয় পণ্য জামদানী মেলা ২০২৪’ আয়োজনের অনুমতির জন্য বাংলাদেশ জামদানী ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্ট এসোসিয়েশনের কার্যকরী সদস্য এ মাজেদ বরিশাল জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে বরিশাল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার (এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট) মো. শহীদউল্লাহ স্বাক্ষরিত ০৫.১০.০৬০০ ১০৬.৫০১০১.২৪.৯৩৫ নং স্মারকে ১৪ টি শর্ত সাপেক্ষে ২০২৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর থেকে আগামী ২০২৫ সালের ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩০ (ত্রিশ) দিনব্যাপী জামদানী মেলার অনুমতি প্রদান করেন। শর্তগুলোর মধ্যে হলো-উচ্চস্বরে কোন প্রকার মাইক কিংবা সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করা যাবে না; কোন প্রকার জুয়া, হাউজি, লটারীর আয়োজন করা যাবে না, কোন প্রকার গান কিংবা নাচের অনুষ্ঠান করা যাবে না ; পুতুল নাচ, যাত্রা বা অশ্লীল নৃত্যের আয়োজন করা যাবে না; অসামাজিক বা অনৈতিক কোন কার্যকলাপ সংঘটিত করা যাবে না; কোন প্রকার মাদকদ্রব্য কিংবা নেশাজাতীয় দ্রব্য মেলায় যাতে কেউ সরবরাহ বা ক্রয়-বিক্রয় করতে না পারে তা নিশ্চিত করা; মানুষের চোখে দৃষ্টিকটু মনে হয় এমন সকল প্রকার কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে হবে; বিকাল ০৫ টা হতে রাত ০৯ টা পর্যন্ত মেলার কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে; গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সিসি ক্যামেরা স্থাপনের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে; মেলা প্রদর্শনের সকল ক্ষেত্রে মেলা পরিচালনা কমিটি কর্তৃক নিজস্ব উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবক টিমের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে নারী দর্শনার্থীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে এবং নারীদের নিরাপত্তায় নারী স্বেচ্ছাসেবক টিম রাখতে হবে; কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে মেলার কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য থাকবে; মাহফিল, নামাজ কিংবা ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষায় বিঘœ সৃষ্টি হতে পারে এমন কার্যক্রম করা যাবে না; নিরাপদ পার্কিং এর ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং যানবাহনের নিরাপত্তায় স্বেচ্ছাসেবক টিম নিয়োজিত করতে হবে। উপরোল্লিখিত যে কোন শর্ত লঙ্ঘিত হলে উক্ত মেলার অনুমোদন তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল করা হবে।
সরেজমিনে স্টল মালিক, আগত দর্শনার্থী ও সংশ্লিস্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে, জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে গৌরনদী বন্দরে পৌরসভার বালুর মাঠের চারদিকে টিনের বেড়া দিয়ে ৬০টি স্টল ও একটি নৌকার দোলা (রাইড), ১টি ড্রাগন ট্রেন রাইড, ১টি ভূতের ঘর নির্মাণ করেন। পৌরসভাকে ইজারা ও সরকারকে কোন রাাজস্ব না দিয়ে আয়োজক কমিটি অবৈধ ভাবে প্রতিটি স্টল বরাদ্দের জন্য ৫০ হাজার টাকা করে ও ফুসকা-চটপটির স্টল, বড় একটি শাড়ি থ্রি-পিচের স্টল, ২টি রাইড, ভূতের ঘর ১ লাখ টাকা থেকে আড়াই লাখ টাকা নির্ধারন করেন। ধার্য্যকুত টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে স্টল মালিকরা গত ১৬ ডিস্মেবর মালামাল (পন্য সামগ্রী) তুলে গত ১৮ ডিসেম্বর মেলায় বেচাকেনা শুরু করেন। গৌরনদী ও আগৈলঝাড়াসহ পাশর্^বর্তী উপজেলার বিভিন্ন এলাকার লোকজন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ ৫/৬ সহ¯্রাধিক দর্শনার্থী প্রতিদিন মেলায় কেনাকাটা করতে আসেন। প্রশাসনের শর্ত অনুযায়ী প্রতিদিন বিকাল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলা কার্র্র্যক্রম চলার নির্দেশনা থাকলেও আয়োজক কমিটি মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে স্টল বরাদ্দ দিয়ে ও জনপ্রতি ১০টাকা টিকেট বিক্রি করে প্রতিদিন সকার ১০টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত মেলা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। সকালে মেলায় দর্শনার্থী ও ক্রেতাদের তেমন একটা ভিড় না থাকলেও বিকাল ৩টা থেকে রাত ১১১টা পর্যন্ত মেলায় দর্শনার্থীসহ নারী-পুরুষ, শিক্ষার্থী ও শিশুদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। দিনে ৪ জন পুরুষ ও ১ নারীকে এবং সন্ধ্যায় ৪ পুষুষকে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। সন্ধ্যায় নারী দর্শনার্থীদের ভিড় থাকলেও নিরাপত্তার জন্য সন্ধ্যার পর কোন নারী স্বেচ্ছাসেবক টিমকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়নি। সন্ধ্যায় টিকেট চেক করছে পুরুষ স্বেচ্ছাসেবকরাই। নিজস্ব যানবাহন নিয়ে মেলায় আগতরা ২/৩ যুবককে টাকা দিয়ে যানবাহন পাকিং করছে মেলা ঘেঁষা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যারয় মাঠে। জামদানী মেলা নাম দেওয়া হলেও মেলায় ১টি স্টলে নামমাত্র কিছু জামদানি শাড়ি তোলা হয়েছে, এ ছাড়া কোন কাপড়ের স্টলে জামদানী শাড়ি কিংবা পাঞ্জামী খুজে পাওয়া যায়নি। এমনকি জামদানী ডিজাইনের কোন পণ্য সামগ্রী কোন স্টলগুলোতে খুজে পাওয়া যায়নি।
নির্জনা বস্ত্র বিতানের মালিক আকাশ মাহমুদ বলেন, মাস শেষে স্টল ভাড়া দেড়লাখ টাকা দিতে হবে। শুধু স্টল ভাড়া পোষাতেই প্রতিদিন ৫ হাজার টাকা লাভ করতে হবে। এ ছাড়া দোকানের ডেকারেশন করেছি ৫০ হাজার টাকায়। এরপর কর্মচারীর বেতন দিয়ে আরো ২ লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকা খরচ হবে।
মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুর এলাকার কসমেটিক স্টলের মালিক মো. ওমর শিফাত, হাজেরা গার্মেন্টেসের ম্যানেজার মো. তামিম, নাঈম কসমেটিক স্টলের মালিক হাসান নাহিদ বলেন, আয়োজক কমিটিকে স্টল প্রতি ৫০ হাজার টাকা করে দিতে হবে। বাগেরহাট জেলা থেকে আগত মায়ের দোয়া কসমেটিক স্টলের ম্যানেজার রাকিব হাওলাদার, আচার ঘরের ম্যানেজার তাকের মিয়া, ঢাকা মিনি চাইনিজের ম্যানজার কোরবান মিয়া
জানান, আমরা মেলার আয়োজক কমিটির নির্দেশে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত দোকান (স্টল) খোলা রেখে বেচাকেনা করে আসছি। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ও বিকাল ৩টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত বেচাকেনা ভাালই হচ্ছে।
সরকারি গৌরনদী কলেজ শিক্ষার্থী নাদিরা আক্তার ও আগৈলঝাড়ার টেমার বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী হিরা মনি জানান, এখন স্কুল-কলেজ বন্ধ তাই সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মেলার কাউন্টার থেকে প্রত্যেকে ১০ টাকা করে দিয়ে টিকেট কেটে বাণিজ্য মেলায় প্রবেশ করেছি। আগামি ১ জানুয়ারি বই উৎসবের মধ্যে দিয়ে পুবোদমে ক্লাস শুরু হবে। স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা চলাকালিন সময় এ মেলা চললে শিক্ষার্থীদের পড়াশুনা বিঘœ ঘটবে।
অধিকাংশ শর্ত অমান্য করার অভিযোগ অস্বীকার করে মেলার পরিচালক আজগর সরদার বলেন, অনুমতির শর্তে বিকাল ৫টা থেকে রাত ৯টায় পর্যন্ত মেলা কার্যক্রম চলার কথা লেখা থাকে, কিন্তু সব জায়গার মত আমরাও সকাল ১০টা মেলা কার্যক্রম শুরু করি। স্টল বরাদ্দ না দিলে ও টিকেট বিক্রি না করলে খরচ কিভাবে উঠাবো। কত টাকা পৌরসভাকে ইজারা ও সরকারকে রাজস্ব দেওযা হয়েছে তা আমি জানি না।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার (এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট) মো. শহীদউল্লাহ্ বলেন, ডিএসবি রিপোর্টর ভিত্তিতে ১৪টি শর্ত সাপেক্ষে ৩০ দিনব্যাপী গৌরনদীতে জামদানী মেলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। মেলার অনুকূলে কত টাকা রাজস্ব দেওয়া হয়েছে জানতে চাইলৈ তিনি বলেন, ডিসি স্যারের নির্দেশে মেলার অনুমতি দিয়েছি। উল্লেখিত যে কোন শর্ত লঙ্ঘিত হলে উক্ত মেলার অনুমোদন তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল করা হবে।
এএসআর/এমআর