গৌরনদী (বরিশাল) সাগরকন্যা প্রতিনিধি॥
বৃহত্তর গৌরনদী উপজেলার বিভিন্ন এলাকার শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী, যুবকসহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষের জ্ঞান আহরণের জন্য এক সময় সরব ছিল ‘গৌরনদী শহীদ স্মৃতি পাঠাগার‘। তবে সংরক্ষণের অভাবে বিভিন্ন ভাষার দুর্লভ ১৫ হাজার গ্রন্থের ভান্ডার এই পাঠাগারটি এখন নিজেই যেন স্মৃতি। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতি স্মরণে নির্মিত এই পাঠাগারটি এখন উইপোকা আর ইঁদুরের নিরাপদ বাসস্থান।
সরেজমিনে গিয়ে এলাকার বর্ষীয়ান ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে ১৯৭৫ সালের ৭ মে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে সরকারি গৌরনদী কলেজের সম্মুখে পাঠাগারটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত। প্রতিষ্ঠার পর থেকে পদাধিকার বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পাঠাগারের সভাপতি’র দায়িত্ব পালন করে আসছিল। ২বছর মেয়াদী পরিচালনা কমিটির সাধারন সম্পাদকসহ নেতৃবৃন্দরা সাধারন সদস্য ও আজীবন সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হতো। প্রতিদিন প্রায় ২শ থেকে ৩শ পাঠক এসে বই পড়তেন এই পাঠাগারে। এছাড়া প্রায় শতাধিক সদস্য নিবন্ধন করে বই পড়তে বাড়ি নিয়ে যেতেন।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, এক সময়ের সরব এই পাঠাগারে ছিল ছয় হাজার নিবন্ধিত বিভিন্ন ভাষার দুর্লভ বই ও প্রতিদিনের বাংলা-ইংরেজী এবং সাপ্তাহিক পত্রিকা। ছিল পরিচালনা কমিটি এবং সহস্রাধিক আজীবন ও সাধারণ সদস্য। ছিল আটটি বৈদ্যুতিক ফ্যান, ১৫০টি চেয়ার ও ১৫টির মত বড় টেবিল। তিন কক্ষ বিশিষ্ট এই পাঠাগারটির দেখভাল করতেন একজন লাইব্রেরিয়ান, একজন সহকারী লাইব্রেরিয়ান ও একজন নাইটগার্ড। পাঠাগারের বৈদ্যুতিক বিল ও স্টাফ বেতন দেয়া হত সদস্যদের চাঁদা ও বিশিষ্টজনদের অনুদান এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কর্যালয়ের বিশেষ অনুদানের মাধ্যমে। সরকারি ভাবে বাংলাদেশ বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রতিবছর সাত হাজার টাকার বই দেয়া হত এই পাঠাগারে। তবে ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৮ সালে পাঠাগারটির রক্ষনাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয় গৌরনদী পৌরসভা। আর তখন থেকে সদস্যদের চাঁদা থেকে বৈদ্যুতিক ও যাবতীয় খরচ এবং পৌরসভা থেকে বিশেষ বরাদ্দকৃত অর্থের মাধ্যমে পাঠাগারের স্টাফদের বেতন খরচ বহন করা হত।
গৌরনদী শহীদ স্মৃতি পাঠাগারের আজীবন সদস্য মো. সাইদ বীন ভূঁইয়া (পান্নু) বলেন, ২০১১ সালে যখন হারিছুর রহমান প্রথম পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন তখন পৌরসভার থেকে আসা পাঠাগারের জন্য বিশেষ বরাদ্দকৃত অর্থ বন্ধ করে দেন তিনি। এরপর থেকে স্টাফদের বেতন ও যাবতীয় খরচ বহনে হিমশিম খেতে হয়। পরবর্তীতে যখন আওয়ামীলীগ দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসে তখন পাঠাগারের সমস্ত দায়িত্ব পৌরসভার বলে লাইব্রেরিয়ানের কাছ থেকে চাবি নিয়ে যান হারিছুর রহমান। গৌরনদী বাসস্ট্যান্ডস্থ উপজেলা আ’লীগ কার্যালয় নির্মাণের সময় পাঠাগারে সিমেন্ট রাখতে ও নির্মাণ শ্রমিকদের থাকতে দেয়া হয়। শ্রমিক থাকার কারণে পাঠাগারে যত্রতত্র মানুষ অবাধে আনাগোনা শুরু করে। একপর্যায়ে দেখা যায় পাঠাগারের ছয় হাজার বইয়ের একটি বইও নেই। তাছাড়া এই সুযোগে কিছু মাদকসেবী ও ছিচকে চোর পাঠাগারের জানালার গ্রিল ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে পাঠাগারের বিভিন্ন আসবাবপত্র চুরি করে নিয়ে যায়। পাঠাগারের চার বারের সাবেক সাধারন সম্পাদক ও গৌরনদী প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং সরকারি গৌরনদী কলেজের সাবেক উপাধ্যাক্ষ মো. মহিউদ্দিন বলেন, পাকা ভবন হওয়ার পরে আরো জমাজমাট হয়ে উঠেছিল লাইব্রেরীটি। তখন লাইব্রেরীর পাঠক বা সদস্য হওয়া ছিল অনেকের কাছে গর্বের। লাইব্রেরীটি পাঠকদের জ্ঞান সমৃদ্ধ করতে আত্মার খোরাক ছিল এবং তরুণ প্রজন্মকে সামাজিক অবক্ষয় থেকে রক্ষার হাতিয়ার ছিল। লাইব্রেরীটি বন্ধ হওয়ার কারণে সামাজিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। ১৯৯৮ সালে তৎকালিন উপজেলা আ’লীগের সভাপতি কালিয়া দমন গুহ সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর আর কোন পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়নি। গৌরনদী পাবলিক লাইব্রেরীটি (গৌরনদী শহীদ স্মৃতি পাঠাগার) পুনর্জ্জীবিত করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই।
গৌরনদীর প্রবীণ কবি ও লেখক সিকদার রেজাউল করিম জানান, প্রথমে এই পাঠাগারটির নাম গৌরনদী শহীদ স্মৃতি পাঠাগার হিসেবে নামকরণ করা হয়। ক্ষমতার পালা বদলে এর নাম পরিবর্তন করে গৌরনদী পাবলিক লাইব্রেরী করা হলেও আবার পুনরায় এর নাম গৌরনদী শহীদ স্মৃতি পাঠাগার করা হয়। আমার নিজের চোখে দেখেছি বাংলা, ইংরেজী, আরবী, ফারসি ভাষার অনেক দুর্লভ গ্রন্থ ছিল এ জ্ঞান ভান্ডারে। পাঠাগারটির এই বর্তমান অবস্থার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটি পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবী জানান তিনি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবু আবদুল্লাহ খান বলেন, গৌরনদী শহীদ স্মৃতি পাঠাগারটি বেহাল অবস্থা। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতি স্মরণে নির্মিত এই পাঠাগারটি সংরক্ষণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে অচিরেই আমরা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
এএসআর/এমআর