ঢাকায় গুলিবিদ্ধে নিহত জামালের পরিবারে শোক

প্রথম পাতা » বরিশাল » ঢাকায় গুলিবিদ্ধে নিহত জামালের পরিবারে শোক
বৃহস্পতিবার ● ১ আগস্ট ২০২৪


ঢাকায় গুলিবিদ্ধে নিহত জামালের পরিবারে শোক

গৌরনদী (বরিশাল) সাগরকন্যা প্রতিনিধি॥

মোর মেয়েকে লইয়্যা মুই এহন কিভাবে বাঁচমু। কেডা মোর মেয়েকে দেখবে ও লেখাপড়া করাইবে। বিয়ার পর মোরে লইয়্যা ঢাকায় যাইয়া কত কষ্ট করেছে, কষ্ট কইরা মেয়েকে পড়াশুনা করাইয়া মেট্টিক পাস করাইছে। বিদেশে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগেই আল্লা অরে (স্বামী) লইয়া গেল। মোগো  মাথা গোঁজার ঠাঁই নাই। কি কইরা মুই ধারদেনার সাড়ে ৫ লাখ টাকা দিমু।  মোর মেয়েকে লইয়্যা মুই কি খাইমু, মেয়েকে কিভাবে পড়াইমু, আল্লা কিভাবে বাঁচমু ? বিলাপ করে কথাগুলো বলেছেন কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত বরিশালের গৌরনদী উপজেলার শরিকল ইউনিয়নের পূর্ব হোসনাবাদ গ্রামের রং মিস্ত্রি জামাল হোসেন শিকদারের বিধবা স্ত্রী শিউলী আফরোজ (৩৭)। বিদেশে যাওয়ার জন্য কেনাকাটা করতে গিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম (চিটাগাং রোডে) মহাসড়কে নারায়নগঞ্জ জেলার সিদ্দিরগঞ্জ থানাধীন সাইনবোর্ড এলাকায়  ২০ জুলাই (শনিবার) বিকাল ৫টার দিকে গুলিবিদ্ধ হয়ে জামাল হোসেন শিকদার (৪০) মারা যায়।
গত  ২২ বছর ধরে ঢাকা মহানগরীর রায়ের বাজার এলাকায়   বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করে রং মিস্ত্রির কাজ করে অর্ধহারে অনাহারে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে আসছিল ভূমিহীন দরিদ্র জামাল হোসেন শিকদারের পরিবারটি। শনিবার দিবাগত (২১ জুলাই) ভোররাত সাড়ে ৩টার দিকে পূর্ব হোসনাবাদ গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক গোরস্থানে জামালের লাশ দাফন করা হয়। নিহত জামাল ওই গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের মরহুম মহাসিন হোসেন শিকদার ও মরহুম ছালেহা বেগমের ছোট ছেলে। ৩ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে জামাল ছিল সবার ছোট।
গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত জামাল হোসেন শিকদারের বিধবা স্ত্রী শিউলী আফরোজ বলেন, বিয়ের  পর ২০০৩ সালের জানুয়ারি  মাসে আমার স্বামী জামাল হোসেন আমাকে সঙ্গে করে ঢাকা মহানগরীর রায়েরবাজার এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করে রং মিস্ত্রির কাজ করে আসছিল। আমাদের তিন সদস্য পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বামী জামাল হোসেনের আয় দিয়েই অর্ধহারে অনাহারে আমাদের সংসার চলছিল। সৌদি প্রবাসে যাওয়ার জন্য গত ৩ মাস পূর্বে স্বামী জামাল হোসেন শিকদার ধারদেনা ও ঋণ করে সৌদি প্রবাসী মো. রনজু মিয়াকে নগদ সাড়ে ৫ লাখ টাকা দেয়। গত ২৭ জুলাই স্বামী জামালের সৌদি আরব যাওয়ার ফ্লাইট হওয়ার কথা  ছিল। আমাদের একমাত্র মেয়ে নুজহাত হোসেন জিতু(১৬)কে গত ১৬ জুলাই   ঝিকাতলা  বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজে ভর্তি করাই। ওইদিন বিকালে আমরা তিনজনে নারায়নগঞ্জ জেলার সিদ্দিরগঞ্জ   থানাধীন চিটাগাং রোডে পাইনাদি নতুন মহল্লায় এলাকায় সহোদর বোন আখিনুর বেগম ও ভাই তাওহীদ চৌধুরীর বাসায় বেড়াতে যাই।
সিদ্দিরগঞ্জের পাইনাদি নতুন মহল্লার ভাড়াটিয়া নিহতের শ্যালক তাওহীদ  চৌধুরী বলেন, সৌদি আরবে নিতে চিটাগাং রোডে সাইনবোর্ড এলাকায় আহসানউল্লাহ্ সুপার মর্কেটে কেনাকাটা  করার জন্য ২০ জুলাই বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে পাইনাদি নতুন মহল্লার আমার ভাড়াটিয়া বাসা থেকে আমি ও আমার দুলাভাই (ভগ্নিপতি) জামাল হোসেন বের হই । বিকাল ৫টার দিকে আমরা ২ জনে সাইনবোড এলাকার আহ্সানউল্লা সুপার মার্কেটের কাছে পৌছি । এ সময় অনেক দূর থেকে দেখি  হেলিকপ্টার থেকে ও ডাচবাংলা বাংকের ছাদ থেকে একদল পুালশ আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করলে গুলিবিদ্ধ হয়ে ২ ছাত্র লুটিয়ে পড়ে । তখন আমি ও দুলাভাই বাঁচতে  দৌড় দিলে একটি গুলি এসে দুলাভাই জামাল হোসেনের বাম পায়ের উরুতে  (কোমড়ের একটু নিচে) বিদ্ধ হয় । তখন সে  (জামাল) লুটিয়ে পড়ে । মারাত্মক জখম অবস্থায় দুলাভাইকে আমি খানপুর সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক  তাকে (জামাল) প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে অপারেশন করে গুলি বের করা লাগবে বলে জানায় ।   হাসপাতালে অপারেশনের ডাক্তার  উপস্থিত নেই বলে তাকে  (জামাল) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয় । ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার পথিমধ্যে  দুলাভাই ঞ্জান হারিয়ে ফেললে  সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে  শান্তিনগর অরোরা স্পেশালাইজড হস্পিটালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন ।  পোস্টমর্টাম ছাড়াই জামালের লাশ গ্রহন করে  রাত ৯টার দিকে রায়েরবাজার এলাকায় নিয়ে আসি । এরপর  সেখান থেকে স্বজনরা ওইদিন রাতেই জামালের লাশ গ্রামের বাড়ি পূর্ব হোসনাবাদ গ্রামের এনে রোববার  (২১ জুলাই) ভোররাত সাড়ে ৩টার দিকে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয় ।
সরেজমিনে স্থাণীয়দের সাথে কথা বলে জানাগেছে, কাজের উদ্দেশ্যে এক সপ্তাহ পরই সৌদি আরবে যাওয়ার কথা ছিল জামাল হোসেনের। সে জন্য  পরিবারের চলছিল শেষ মূহুর্তের প্রস্তুতি। কিন্তু তার আগেই ২০ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। একমাত্র উপার্জনক্ষম জামাল হোসেনের এমন মৃত্যুতে লন্ডভন্ড হয়ে যায় পরিবারের স্বপ্ন। বাড়িতে এখন সুনসান নিরবতা। উপার্জনক্ষম জামাল হোসেনের মৃত্যুতে তার পরিবারটি অসহায় হয়ে পড়েছে। এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না পরিবারের সদস্যরা। এমন মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠ  তদন্ত ও বিচার দাবি করেছে  নিহতের স্বজনরা। করেছেন সরকারি সহায়তার। ৩ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে জামালের বড় ভাই জাকির হোসেন রোকন ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে   গত ৫ বছর পূবে ও চলতি বছরের ২০ জুলাই বিকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে ছোট ভাই জামাল হোসেন শিকদার মারা যায়। আড়িয়াল খাঁর শাখা পালরদী নদীর ভাঙ্গনে তার পৈতৃক ভিটাবাড়ি ও আবাদি জমি বিলিন হয়ে গেছে। গত ১০ বছর পূর্বে  তার পিতা   মহাসিন হোসেন শিকদার ইন্তেকালের সময়   মাত্র ২ শতাংশ  ভিটা বাড়ি রেখে   গেছে। তার পৈতৃক ভিটায় কোন ঘর নেই। তাই নিহত জামালের পবিবারের সদস্যদের মাথা গোজার ঠাঁইও নেই। তারা গ্রামের বাড়িতে এলে যার যার শ^শুর (বাপের) বাড়িতে থাকেন।

 

 

এমসআর/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ২২:২৬:১৫ ● ১১৫ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ