গৌরনদী (বরিশাল) সাগরকন্যা প্রতিনিধি॥
মুই এ্যাহন সন্তান লইয়্যা কিভাবে বাচঁমু। যহন একটু সুখের মুখ দ্যাখলাম তহন আল্লা ওরে (স্বামী) লইয়্যা গেল। কেডা মোর সন্তানকে দেখবে। মোর কপালে সুখ সইল না, মোরে লইয়্যা ঢাকায় আইয়া কত কষ্ট করছে, যহন একটা চাকুরী পাইল হেই সময় আল্লা অরে লইয়া গেল। মুই এ্যাহন কিভাবে বাঁচমু, কে মোর ছোট সন্তানকে মানুষ করবে। মুই ওর অফিসের নেওয়ার রাইতের খাবার রেডি কইরা বইয়া আছিল্যাম, কই ওতো আহে না। বিলাপ করে কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা মহানগরীর শাহজাদপুর বাজারে ওষুধ কিনতে যাওয়ার পথিমধ্যে গত ১৯ জুলাই (শুক্রবার) বিকাল পৌণে ৬টার দিকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া বরিশালের গৌরনদী উপজেলার নলচিড়া ইউনিয়নের কালনা গ্রামের সাবেক সেনা সদস্য নজরুল খলিফার একমাত্র ছেলে ইমরান হোসেনের বিধবা স্ত্রী শান্তা মিয়া (২৫)। গুলশান-২ এ চারুলতা নিবাস নামের ১২তলা ভবনের নিরাপত্তা কর্মি হিসেবে চাকরী করতেন মো. ইমরান হোসেন (৩৩)। শনিবার (২০ জুলাই) বেলা ১১টার দিকে কালনা গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক গোরস্থানে ইমরানের লাশ দাফন করা হয়। নিহত ইমরান ওই গ্রামের সাবেক সেনা সদস্য নজরুল খলিফা (৫৭) ও সেলিনা বেগমের (৫০) একমাত্র ছেলে। এক ভাই ও ২ বোনের মধ্যে ইমরান ছিল সবার বড়।
গুলিবিদ্ধে নিহত ইমরান হোসেনের স্ত্রী শান্তা মিয়া (২৫) জানান, ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে স্বামী ইমরান হোসেন তাকে (স্ত্রী) ও পুত্র ইয়াজ খলিফাকে (২৩ মাস) নিয়ে ঢাকায় যায়। ঢাকা মহানগরীর শাহজাদপুর খন্দকারবাড়ির মোড়ে দোকান ভাড়া নিয়ে ইমরান হোসেন মুদি দোকান দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসায় লোকসান হলে মুদি দোকান ছেড়ে দিয়ে গত ৩ মাস পূর্বে ফুটপাতের জুতার দোকান দেয় ইমরান। জুতার ব্যবসার আয় দিয়ে কোন রকম তাদের সংসার চলছিল। স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে ইমরান হোসেন শাহজাদপুর খিলবাড়িটেক নামক স্থানে বাসাভাড়া নিয়ে কোনরকম বসবাস করে আসছিল। খুবই কষ্টোর মধ্যে চলে তাদের সংসার। গত ৩ জুলাই গুলশান-২ এলাকায় চারুলতা নিবাস নামে ১২তলা ভবনের নিরাপত্তা কর্মি হিসেবে চাকুরী পান ইমরান হোসেন। স্ত্রী আরো জানান, ঘটনার দিন শুক্রবার (১৯ জুলাই) স্বামী ইমরানের অফিসে ডিউটি ছিল সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। কিন্তু সে (স্ত্রী) অসুস্থ হওয়ার কারণে আগের দিন রাতে অফিসের বড় স্যারেরে ফোন দিয়ে ডিউটির সময় পরিবর্তন করে শুক্রবার রাত ৮টা থেকে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডিউটি করার অনুমতি নেন। শুক্রবার দুপুরে অফিস থেকে একজন ( স্যারে) ফোন দিয়ে ইমরানকে বলে যদি পরিস্থিতি ভাল থাকে তাহলে অফিসে এসো আর যদি পরিস্থিতি খারাপ থাকে তাহলে অফিসে আসার দরকার নাই। শুক্রবার ১৯ জুলাই বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ইমরান অফিসে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাতের খাবার প্রস্তুত করতে তাকে (স্ত্রীকে) বলে ঘরের বাইরের পরিস্থিতি দেখতে ও তার জন্য ওষুধ কিনতে ভাড়াটিয়া বাসা থেকে বের হয়ে বিকেল পোনে ৬টার দিকে শাহজাদপুর বাজারে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে খবর পেয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে গিয়ে গুলিবিদ্ধ স্বামী ইমরান হোসেনের লাশ শনাক্ত করেন। পরে ময়নাতদন্ত ছাড়াই ইমরানের লাশ ইউনাইটেড হাসপাতাল থেকে রাত সাড়ে ৯টার দিকে গ্রহন করে ইমরানের লাশ নিয়ে শনিবার ভোররাতে গ্রামের বাড়িতে আসেন। গুলিবিদ্ধে নিহত ইমরান হত্যার বিচার দাবি জানিয়েছেন নিহতের স্ত্রী শান্তা মিয়া।
নিহতের বাবা নজরুল খলিফা বলেন, শুক্রবার (১৯ জুলাই) সন্ধ্যা ৭টার দিকে বাবা ইমরানের ফোন থেকে কল আসে, ডাক্তার পরিচয়ে একজন বলে ইমরান খুবই অস্স্থু গুলশান ইউনাইটেড হাসপাতালে আছে। পরে আমি ছেলের বউকে (পৃত্রবধু) জানালে বউ মা হাসপাতালে গিয়ে দেখে কয়েকটি লাশের সঙ্গে পড়ে আছে আমার বাবার লাশ। পরে সে ফোনে আমাকে জানায় ইমরান গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। বাবার কি কষ্ট হইছে, বাম পাজর দিয়ে গুলি ঢুকে ডান পাজর দিয়ে নারীভূড়িসহ বের হয়েছে।
ইমরান হোসেন সম্পর্কে জানতে চাইলে কালনা গ্রামের গ্রামের ফরিদ খলিফা (৬০), মোঃ জালাল সরদার (৭০) বলেন, ইমরানকে ছোট বেলা থেকেই চিনি জানি, সে খুবই নিরহ ও ভদ্র প্রকৃতির মানুষ। জোরে একটা কথাও বলতে শুনিনি কিংবা কোন রাজনীতি করতে দেখিনি। গুলিতে এভাবে ছেলেটি মারা যাবে ভাবতেও পারিনি। তারা নিহত ইমরানের অসহায় পরিবারের প্রতি সহযোগীতার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান।
গৌরনদী থানার ওসি আনোয়ার হোসেন বলেন, ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত জামাল শিকদার ও ইমরাম হোসেন খলিফার লাশ তাদের গ্রামের বাড়ি গৌরনদী উপজেলার পূর্ব হোসনাবাদ ও কালনা গ্রামের পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করার খবর আমরা জানতে পেয়েছি।
এমসআর/এমআর