সরকারি কোষাগারে জমা হয় না ভূমি রাজস্বের একটি বড় অংশ

প্রথম পাতা » বিশেষ প্রতিবেদন » সরকারি কোষাগারে জমা হয় না ভূমি রাজস্বের একটি বড় অংশ
রবিবার ● ২০ জানুয়ারী ২০১৯


সরকারি কোষাগারে জমা হয় না ভূমি রাজস্বের একটি বড় অংশ

ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥

সরকারি কোষাগারে জমা হচ্ছে না ভূমি খাত থেকে আদায় হওয়া রাজস্বের একটি বড় অংশ। ওই অর্থ যাচ্ছে এক শ্রেণির অসাধু ভূমি কর্মকর্তার পকেটে। মাঠপর্যায়ে ভূমি অফিসে জালিয়াতির কারণে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়ালে ভূমি অফিসের কার্যক্রম তদারকির বিধান থাকলেও তা করা হচ্ছে না। ফলে ওই খাত থেকে আদায় হওয়া রাজস্ব আত্মসাতের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। তবে নতুন ভূমিমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুয়া চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে ভূমি উন্নয়ন করসহ অন্যান্য খাতের রাজস্ব জমা দেয়ার নামে আত্মসাৎ করা হচ্ছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের হিসাব নিয়ন্ত্রক (রাজস্ব) দপ্তরের নিরীক্ষায় সরকারের রাজস্ব লুটে খাওয়ার চিত্র বেরিয়ে এসেছে। তথ্যপ্রমাণসহ নিরীক্ষা প্রতিবেদন সংশ্নিষ্ট জেলা প্রশাসকের কাছে নিয়মিত জমা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রতিবেদনে আত্মসাৎকৃত অর্থ আদায় ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করা হলেও রহস্যজনক কারণে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। বরং প্রতিবেদনগুলো বছরের পর বছর ফেলে রাখা হয়। একপর্যায়ে সেগুলো তামাদি হয়ে যায়। ভূমি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে,  ভূমি উন্নয়ন কর আদায় থেকে চালান পর্যন্ত তিনটি স্তওে টাকা আত্মসাৎ করা হয়। ভূমি মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষায় ওই জালিয়াতির চিত্র উঠে এসেছে। ভূমির প্রতিটি নামজারির ক্ষেত্রে এক হাজার ১৫০ টাকা হারে ফি আদায় করার নিয়ম থাকলেও সহকারী কমিশনার-ভূমি (এসিল্যান্ড) অফিস থেকে ওই ফি আদায় করা হয় না বললেই চলে। অথচ জমি ক্রেতার পক্ষে নামজারি করে ফি আদায়ের বিধান রয়েছে। মূলত অনেক ঘোরাঘুরি ও খড়কুটা পুড়িয়ে নামজারি-সংক্রান্ত খতিয়ান পাওয়ার পর জমির ক্রেতা খুশি হয়ে এসিল্যান্ড ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে সন্তোষজনক সেলামি দেয়ার পর নামজারি ফি আদায়ের তারা কথা ভুলে যান। এতে সরকার ওই খাতের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক নিরীক্ষায় পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ উপজেলায় নামজারি ফির ৫ লাখ ১২ হাজার টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাছাড়া ভূমি অফিসের রেজিস্টার ও কেস বইয়ে টাকার হিসাব ওঠানোর ক্ষেত্রে জালিয়াতি করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করা হচ্ছে। উপজেলা ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসের মাধ্যমে আদায় করা ভূমি উন্নয়ন করের টাকার হিসাব প্রথমে তিন নম্বর রেজিস্টারে ওঠানো হয়। পরে ওই টাকা কেস বইয়ে জমা দেখানো হয়। কিন্তু ভূমি অফিসের কার্যক্রম নিরীক্ষার সময় দেখা গেছে, রেজিস্টারে ৪ লাখ ২৩ হাজার ৫০০ টাকা জমা দেখিয়ে কেস বইয়ে ২৩ হাজার ৫০০ টাকা জমা দেখানো হয়েছে। সেক্ষেত্রে আত্মসাৎ করা হয়েছে ৪ লাখ টাকা। তিন নম্বর রেজিস্টারে প্রতিদিনের জমা হওয়া টাকা যোগ করার ক্ষেত্রে মোট টাকায় কম দেখানো হয়। একটি হিসাবের ক্ষেত্রে দেখা যায়, যেখানে মোট টাকা ৮ লাখ ৫০ হাজার ৪৩২ টাকা, সেখানে লেখা হয়েছে ৬ লাখ ৫০ হাজার ৪৩২ টাকা। ওই পর্যায়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে দুই লাখ টাকা। পরে তিন নম্বর রেজিস্টারে জমার মোট হিসাব কেস বইয়ে ওঠানো হয়। তাছাড়া আদায় করা ভূমি উন্নয়ন করের প্রতিদিনের টাকা চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা করার বিধান থাকলেও তা হচ্ছে না। ভূমি অফিসের কার্যক্রম নিরীক্ষায় দেখা যায়, ১৫-২০ দিন পর পর কেস বইয়ে জমা টাকার হিসাব করে সরকারি কোষাগারে জমা করা হয়। সেক্ষেত্রে ১৫-২০ দিনের টাকা যোগ করে মোট হিসাবে কম দেখিয়ে আত্মসাৎ করা হয়। আদায় হওয়া টাকা তিন নম্বর রেজিস্টার থেকে কেস বইয়ে ওঠানোর পর সরকারের সংশ্নিষ্ট খাতের কোষাগারে ব্যাংকের চালানের মাধ্যমে জমা করতে হয়। চালান পাঠানোর পর কেস বইয়ে প্রতিটি চালান নম্বর, টাকার পরিমাণ, তারিখ, ব্যাংকের নামসহ অন্যান্য তথ্য লিপিবদ্ধ করতে হয়।
সূত্র জানায়, হিসাব নিয়ন্ত্রকের (রাজস্ব) দপ্তরের নিরীক্ষকরা সারাদেশের ভূমি অফিসের কার্যক্রম নিয়মিত নিরীক্ষা করে। তারা ভূমি উন্নয়ন কর, ইজারা, নামজারি ফি, সার্টিফিকেট কেসের অনাদায়, কোর্ট ফি, ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন, আবাসিক-বাণিজ্যিক ও শিল্পাঞ্চলের খাজনা, নদীভাঙনে ভূমির প্রকৃত অবস্থা, নতুন চরাঞ্চলের রাজস্ব আদায়সহ অন্যান্য হিসাব নিরীক্ষা করে। নিরীক্ষকরা রাজস্ব তছরুপের নিরীক্ষা প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, এডিসি (রাজস্ব) ও ভূমি মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। কিন্তু ওসব প্রতিবেদন হাতে পেয়েও জেলা প্রশাসকরা অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে হঠাৎ কখনো কারো বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে অভিযুক্ত আত্মসাৎকৃত টাকা ফেরত দিতে রাজি হয়। টাকা আদায় হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ভূমি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে মন্ত্রণালয়ের হিসাব নিয়ন্ত্রকের (রাজস্ব) দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলদের মতে, আত্মসাৎকৃত টাকা ফেরত দিলেই অপরাধী ছাড় পেতে পারে না। টাকা আদায়ের সঙ্গে তার অপরাধেরও বিচার হওয়া জরুরি। অনেক সময় এসিল্যান্ডদের বিরুদ্ধেও সরকারি অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া যায়। সারাদেশের এসিল্যান্ডরা ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন। সেক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় থেকেও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় না। ফলে ঢাকাসহ সারাদেশের সাব-রেজিস্ট্রারের অফিস থেকে জমির প্রকৃত শ্রেণি টেম্পারিং করে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের জমির শ্রেণি উল্লেখ করে দলিল তৈরি করে প্রতি বছর সরকারকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে যেসব দলিলে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়েছে, এসিল্যান্ড বেআইনিভাবে ওসব দলিল অনুযায়ী নামজারি করছেন।
সূত্র আরো জানায়, হিসাব নিয়ন্ত্রকের (রাজস্ব) দপ্তরের এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী বিগত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সারাদেশে ভূমি খাত থেকে পৌনে ৬ কোটি টাকার রাজস্ব আত্মসাৎ করা হয়। উপজেলা ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসের হিসাব নিরীক্ষা করে ওই তথ্য পাওয়া গেছে। আদায় হওয়া খাজনা, ইজারাসহ অন্যান্য খাতের রাজস্ব সরকারের কোষাগারে জমা না দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন সংশ্নিষ্ট ভূমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ওই অর্থবছরে আত্মসাৎ করা হয় মোট ৫ কোটি ৭৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। ভূমি মন্ত্রণালয়ের ২০১৩-১৪ অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে নওগাঁ, নড়াইল, ময়মনসিংহ, বরিশাল, নরসিংদী, গাজীপুরসহ বিভিন্ন জেলায় রাজস্ব আত্মসাতের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
এদিকে এ প্রসঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়ের হিসাব নিয়ন্ত্রক (রাজস্ব) দপ্তরের প্রধান মশিউর রহমান জানান, ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল অনুযায়ী উপজেলা, ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব রয়েছে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি), সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও কানুনগোর ওপর। নিয়ম অনুযায়ী তারা প্রতি মাসেই সরেজমিন ভূমি অফিসের কার্যক্রম খতিয়ে দেখবেন। প্রকৃতপক্ষে সে কাজটি হচ্ছে না। প্রতি মাসে জেলা প্রশাসকের কাছে ভূমি অফিস-সংক্রান্ত প্রতিবেদন পেশ করার কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। কিন্তু রাজস্ব আত্মসাৎ বন্ধে তদারকি জোরদার করতে হবে।
অন্যদিকে নতুন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ বিগত ৮ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ে প্রথম কর্মদিবসেই ভূমি ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির ঘোষণা দেন। ভূমিমন্ত্রী জানান, ভূমি খাতে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি, আত্মসাৎ বন্ধে দেশের সব ভূমি অফিসকে অটোমেশনের আওতায় আনা হবে। তাতে করে মন্ত্রণালয়ে বসেই জানা যাবে কত তারিখে, কোন খাতে, কত টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে, আর একই দিনে সরকারি কোষাগারে কত টাকা জমা হয়েছে। ফলে রাজস্ব আত্মসাতের কোনো সুযোগ থাকবে না। যদি কেউ এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়, তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ শাস্তি দেয়া হবে। প্রতিটি ভূমি অফিসে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হবে।

এফএন/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ৮:১০:০৯ ● ৫৬১ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ