কলাপাড়ায় আবাসনের বাসিন্দাদের বেহালদশা!

প্রথম পাতা » পটুয়াখালী » কলাপাড়ায় আবাসনের বাসিন্দাদের বেহালদশা!
সোমবার ● ৪ মার্চ ২০২৪


কলাপাড়ায় আবাসনের বাসিন্দাদের বেহালদশা!

মেজবাহউদ্দিন মাননু (কলাপাড়া) সাগরকন্যা অফিস॥

কলাপাড়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি হারানো আশ্রয়হারা মানুষের পুনর্বাসনে সরকারি এবং বেসরকারিভাবে নির্মিত আবাসন-আশ্রয়নের হাজার হাজার ঘর ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে গেছে। জীর্ণদশার কারণে এসব ঘরে আশ্রিত বহু পরিবার পুনর্বাসনের ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। অনেকে আবার বেড়িাঁধের স্লোপে ঝুপড়ি তুলে চরম দুর্যোগঝুঁিকতে থাকছেন। ফলে ফের আশ্রয়হারা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আর পুনর্বাসনের এসব ঘর খালি পড়ে আছে। এমনকি এসব ঘরের টিন-চাল-বেড়া খুলে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। যথাযথ তদারকির ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এসব ঘর বসবাস উপযোগী না থাকায় ছিন্নমূল মানুষের আশ্রয় নেয়ার উদ্যোগ ভেস্তে গেছে।
প্রকৃতির বুলডোজারখ্যাত ঘুর্ণিঝড় সিডর বিধ্বস্তে উপকূলীয় কলাপাড়ায় ১২ হাজার নয় শ’ পরিবার গৃহহারা হয়ে পড়ে। এসব পরিবারকে আশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন ধরনের আবাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়। ঠিকানাহারা এসব মানুষকে পুনর্বাসনে সরকারিভাবে আবাসন, বিশেষ আবাসন, জাপানি ব্যরাক হাউস, আশ্রায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন ইউনিয়নে দেড় শতাধিক ব্যরাক হাউস করা হয়। যেখানে প্রায় দুই হাজার পরিবারের আশ্রয় স্থল করা হয়। এছাড়া বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে পাঁচ হাজার পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়। ২০০৭ সালের সিডর পরবর্তী সময় থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত পুনর্বাসনের কাজ চলতে থাকে। কিন্তু তিন বছর না যেতেই এসব ঘরের এখন ব্যবহার উপযোগিতা নেই। টিনের চাল ঝড়ে উড়ে গেছে। কোথাও আবার স্থানীয় লোকজন খুলে নিয়ে গেছে আবাসন ব্যারাকের বেড়া কিংবা চাল। প্রভাবশালীসহ যারা আবার ওইসব আবাসনে বসবাস করছে তারা একেকজনে একাধিক ব্যরাক দখল করে গবাদিপশু পালন করছে। আবার দরিদ্র কর্মজীবি মানুষের কর্মস্থলের অনেক দুরে কিংবা বিরোধীয় খাস জমিতে এসব আবাসন প্রকল্প করা হয়েছে। মোট কথা কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে সরকার ছিন্নমূল শ্রমজীবি মানুষকে আশ্রয়স্থল করে দিলেও সংশ্লিষ্টদের যথাযথ তদারকির অভাবে সকল উদ্দেশ্য চরমভাবে ব্যাহত হয়ে পড়েছে। এসব মানুষকে একটু ঠিকানার জন্য সরকার এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন করেছিল। শুধু আশ্রয়স্থল নয়, আয় বর্ধনমূলক কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ হিসাবে গড়ে তুলে ক্ষুদ্রঋন দেয়ার প্রক্রিয়াও চালু করা হয়। কিন্তু সবই যেন ভেস্তে যাচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, এসব পুনর্বাসনের বেহালদশার ভয়াবহতার চিত্র। চাকামইয়া ইউনিয়নের গামুরিবুনিয়ায় ২০০৮ সালে এক শ’ পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য ১০টি টিনশেড ব্যারাক করে দেয়া হয়। মনোরম পরিবেশ। ইউ টাইপে তিনদিকে ব্যারাক হাউস। মাঝখানে একটি বিশাল পুকুর। দক্ষিণ দিকে একটি কমিউনিটি সেন্টার রয়েছে। কিন্তু সব বেহালদশা। ১০ নম্বর ব্যরাকের ৭ নম্বর কক্ষের সালমা বাদল হাওলাদার দম্পতি জানালেন, ১২ বছর আগে তারা এখানে উঠেছেন। বর্তমানে থাকার উপায় নেই। চাল উড়ে গেছে মহাসেন ঝড়ে। একই ব্যরাকের চারটি কক্ষ খালি পড়ে আছে। সাত নম্বর ব্যরাকের নয় নম্বর কক্ষে থাকছেন রাবেয়া আলফাজ দম্পতি। ৬ নম্বর ব্যরাকের আটটি কক্ষ খালি পড়ে আছে। বেড়ার টিন উধাও হয়ে গেছে এসব কক্ষের। এই ব্যরাকের তিনটি কক্ষ এখন ব্যবহার হচ্ছে গবাদি পশুর জন্য। ময়লা আবর্জনায় একাকার হয়ে আছে। পাঁচ নম্বর ব্যরাকের ১০টি কক্ষের সাতটি খালি পড়ে আছে। এভাবে এখানকার ১০টি ব্যরাকের ১০০ কক্ষের অন্তত ৪৩টি খালি পড়ে আছে। ৬টি টিউবওয়েলের ৫টি নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার থেকে এরা বঞ্চিত রয়েছেন। এদের আবাসনে যাওয়া-আসার ভোগান্তির যেন শেষ নেই। ঢোকার পথে একটি কাঠের পাটাতনের সাঁকো রয়েছে। যেটিতে শিশুদের যেতে সমস্যা হয়। আবাসনের অন্তত ২২ শিশু এটি পার হয় ঝুঁকি নিয়ে। আবাসনের ঢোকার ওই পথে একটি স্লুইস ছিল। তা ভেঙ্গে এই দশা হয়েছে। বাসীন্দা পিয়ারা বেগম জানান, সম্প্রতি গর্ভবতী এক নারীকে হাসপাতালে নেওয়ায় জন্য ওই পথ পার হতেই সময় চলে যায়। পথে বসেই তার সন্তান হয়। বর্তমানে মা ও নবজাতক বরিশালে চিকিৎসাধীন আছে।
একই অবস্থা চর ধুলাসারের দুইটি ব্যরাকের ২০টি কক্ষের আটটি খালি রয়েছে। চরচাপলীর তিনটি ব্যরাকের ৩০টি কক্ষের ২১টি খালি পড়ে আছে। একটি ব্যরাকের চাল-বেড়া খুলে নেওয়া হয়েছে। আইয়মপাড়া গ্রামের আবাসনের ব্যরাকটিতে বসবাসকারীদের আনুষ্ঠানিকভাবে ঘর বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। অথচ এরই মধ্যে ব্যরাকের টিন চাল জীর্ণদশায় বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। লোহার এ্যাঙ্গেলগুলো ভেঙ্গে গেছে। বৃষ্টি হলেই পানি পড়ছে। সামনের টয়লেট ব্যবহার করা যায় না। মেলাপাড়া গ্রামের আবাসনটি করা হয়েছে ২০১৪ সালে। অথচ অধিকাংশ ঘরের বেড়া কিংবা চালের টিন নষ্ট হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় আবাসন প্রকল্প রয়েছে নীলগঞ্জ ইউনিয়নের নীলগঞ্জ গ্রামের আন্ধার মানিক নদীর পাড়ে। এখানে ২৮টি ব্যারাকে ২৮০টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। কলাপাড়া শহরের উল্টোদিকে হওয়ায় এখানে সবচেয়ে বেশি শ্রমজীবি মানুষ বাস করছে। এসব পরিবারের সদস্যদের সমবায়ের উদ্যোগে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। দেয়া হয়েছে ক্ষুদ্রঋণ। কিন্তু কোনটাই সফলতায় পৌছেনি। ঘরগুলো জীর্ন হয়ে গেছে। যাদেরকে ঘর দেয়া হয়েছে তাদের অনেকে আবার এই ঘর টাকার বিনিময়ে অন্যত্র বিক্রি করে দিয়েছে। চর ধুলাসার আবাসনের বাসিন্দা স্বামী পরিত্যাক্তা রাণী বেগম জানালেন, তাদের কোন ধরনের সহায়তা দেয়া হয় না। ব্যরাক হাউসটির আশপাশে তাদের কাউকে নামতে দেয়া হয় না। হাঁস-মুরগী পালন করতে পারেন না। গবাদিপশু পালনের সুযোগ নেই। সংযোগ সড়ক নেই। লেট্রিনগুলো ভেঙ্গে গেছে। একটি টিউবওয়েল নষ্ট হয়ে গেছে। কর্মসংস্থানও নেই। দুইটি ব্যারাকের নয়টি ঘর খালি পড়ে আছে। একইদশা চাকামইয়া নিশান বাড়িয়া, খাজুরা, ফাঁসিপাড়া, পাখিমারা গুচ্ছ গ্রামের, আনিপাড়া, লেমুপাড়া, লোন্দা, ছোট বালিয়াতলী, তেগাছিয়া, ফতেহপুর আশ্রয়ন কিংবা আদর্শ গ্রামের। মোট কথা আবাসন, আশ্রয়ন কিংবা আদর্শ গ্রাম সবগুলোর এখন চরম বেহালদশা। বসবাস উপযোগিতা নেই। এসব প্রকল্প সরকারি অর্থায়নে করা হয়েছে।
এছাড়াও সিডর পরবর্তী সময়ে সৌদি সরকারের সহায়তা ১৫৪০টি পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। একইভাবে ব্রিটিশ রেডক্রিস্টে ৭৫২টি, স্পিড ট্রাস্ট এক হাজার, ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল ৬০০, সোস্যাল এসিসট্যান্স ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ৪৫টি, উরমাতা বাংলাদেশ ৯৪টি, ব্র্যাক ৩০টি, লায়ন্স ক্লাব ৩০টি, গ্রুপ থিয়েটার বাংলাদেশ ২০টি, অরকা রাজশাহী ৮০টি, ফ্রেন্ডশীপ ৪৯টি, কারিতাস ৬০০টি, স্পিড ট্রাস্ট (একশন এইড) ৮৪টি, প্রথম আলো পত্রিকা একটি পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেয়। কিন্তু এসব ঘর বসবাসের অনুপযোগি হয়ে গেছে। শতকরা ৯০টির কোন অস্তিত্ব নেই।
সরকারি হিসাবে কলাপাড়ায় অন্তত ১৭০টি ব্যারাক হাউস করা হয়েছে। এছাড়া গুচ্ছ গ্রাম ও আদর্শ গ্রাম করা হয়েছে আরও দশটি। যেখানে কমপক্ষে দুই হাজার পরিবারের আবাসস্থল রয়েছে। এরমধ্যে প্রায় দেড় হাজার পরিবার বসবাস করছে। কিন্তু কাগজপত্রে রেজিস্ট্রির মাধ্যমে ৪৯৭ টি পরিবারকে ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে।  এগুলো ছাড়াও রাখাইনদের জন্য তিনটি বিশেষ আবাসন করা হয়েছে। যেখানে ৫৭টি পরিবার বসবাস করছে। বর্তমানে এসব আবাসনের বাস্তব চিত্র কী তা খোদ সরকারি প্রশাসন সঠিকভাবে জানাতে পারেনি। তবে আশ্রিতদের অর্ধেক পরিবার বসবাস করতে পারছে না। এক কথায় চরম বেহালদশা আবাসন প্রকল্পের। হতদরিদ্র এসব পরিবারের মাঁথা গোজার ঠাই মিললেও বর্তমানে তা আবার হারানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, তিনি খোঁজখবর নিয়ে বিষয়টি দেখবেন, কী করা যায়।

 

 

এমইউএম/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ২২:০৯:৫০ ● ৫৯ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ