ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
অনিয়ম, হয়রানি ও ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে পুনঃতফসিল দাবি করেছে প্রতিদ্বন্দ্বী বেশ কয়েকটি ছাত্রসংগঠন ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। সোমবার দুপুর ১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে প্রগতিশীল ছাত্র ঐক্যের ভিপি প্রার্থী লিটন নন্দী, কোটা সংস্কার আন্দোলনের জিএস প্রার্থী রাশেদ খান, স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী অরণী সেমন্তি খান, জিএস প্রার্থী এস এম আসিফুর রাহমান, স্বাধিকার পরিষদসহ বেশ কয়েকজন প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন।
এর কিছু পরে একই স্থানে ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। তাঁরা এই নির্বাচনকে ‘কালো নির্বাচন’ বলে অভিহিত করেন। এর প্রতিবাদের মঙ্গলবার ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এরপরই ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয় ইসলামি শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন। সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পক্ষ থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। সোমবার সকাল ৮টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬টি হলে একযোগে ভোট শুরু হলেও রোকেয়া হল ও কুয়েত মৈত্রী হলে ভোট শুরু করা যায়নি। এক ঘণ্টারও বেশি সময় পর রোকেয়া হলের ভোট শুরু হলেও পরে আবার বন্ধ হয়ে যায়। কুয়েত মৈত্রী হলের ভোট গ্রহণ শুরু হয় সোয়া তিন ঘণ্টা দেরিতে, বেলা ১১টা ১০ মিনিটে। পরে জানা যায়, শিক্ষার্থীরা হলের কুয়েত মৈত্রী হলের একটি কক্ষ থেকে এক বস্তা আগে থেকে সিল মারা ব্যালট পেপার উদ্ধার করেছেন। শিক্ষার্থীদের এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থিত হন প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর ও চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তা। পরে কুয়েত মৈত্রী হলের প্রভোস্টকে অব্যাহতি দিয়ে নতুন প্রভোস্ট নিয়োগ দেওয়া হয়।
অন্যদিকে, রোকেয়া হলের একটি কক্ষ থেকে কিছু ব্যালট পেপার উদ্ধার করা হয়েছে। এগুলো সাদা ব্যালট পেপার। শিক্ষার্থীরা দাবি করেছেন, এগুলো কারচুপি করার জন্যই রাখা হয়েছে। যদিও ছাত্রলীগ এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, বাইরে থেকে এসব ব্যালট নিয়ে এসে নাটক সাজানো হচ্ছে। পরে সেখানে বিভিন্ন প্যানেলের নেতৃবৃন্দ হাজির হন। এখানেই কোটা সংস্কার আন্দোলনের ভিপি প্রার্থী নুরুল হক নুর হামলার শিকার হন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা এই হামলা চালিয়েছে। পরে তাঁকে উদ্ধার করে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। এ ছাড়া বাম জোটের ভিপি প্রার্থী লিটন নন্দীর ওপর হামলার অভিযোগ পাওয়া যায়। এ অবস্থার মধ্যে দুপুর ১টার কিছু পরে মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলনে আসেন প্রগতিশীল ছাত্র, কোটা সংস্কার আন্দোলন, স্বতন্ত্র জোট ও স্বাধিকার জোটের নেতৃবৃন্দ। তারপর সেখানেই সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। এ সময় শিক্ষার্থীরা সেখানে অনিয়মের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন।
ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আপনারা দেখেছেন সকালে রোকেয়া হল, কুয়েত মৈত্রী হল ও সুফিয়া কামাল হলে রাতেই ব্যালটে সিল মেরে রেখে দেওয়া হয়েছে। হলে হলে আমাদের নেতাকর্মীদের নির্যাতন করা হয়েছে। এই নির্বাচন একটা কলঙ্কিত নির্বাচন। ঘৃণাভরে এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করছি। ছাত্রদলের এই নেতা আরো বলেন, আমরা পুনঃতফসিল দাবি করছি। এবং এই নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত সব ধরনের কর্মকর্তার পদত্যাগ দাবি করছি। আমরা হলে ভোটকেন্দ্র না করা, ভোট শেষে হাতে কালি দেওয়াসহ বেশকিছু দাবি করেছিলাম। সেই দাবিগুলো বিবেচনায় নিয়েই আমরা পুনরায় নির্বাচন দাবি করছি। এর পর ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে ভিসির বাসভবনের দিকে চলে যান। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ছাত্রদল সেখানেই অবস্থান করছিল। সংবাদ সম্মেলনে প্রগতিশীল ছাত্র ঐক্যের ভিপি প্রার্থী লিটন নন্দী বলেন, কুয়েত মৈত্রী হল থেকে ভোট গ্রহণের আগেই বস্তাভর্তি সিলমারা ব্যালট পাওয়া গেছে। রোকেয়া হলে এক ঘণ্টা পর ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছে। সেখানে হল প্রাধ্যক্ষের উপস্থিতিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ভিপি প্রার্থী নুরুল হক নুর ও স্বতন্ত্র জোটের ভিপি প্রার্থী অরণী সেমন্তির ওপর হামলা হয়েছে। অধিকাংশ হলে একই শিক্ষার্থী ভোট দিয়ে তারাই আবার লাইনে দাঁড়াচ্ছে। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে আমরা ঢুকতে গেলে ছাত্রলীগ আমাদের ঢুকতে দেয়নি। শহীদুল্লাহ হলের গেট অবরোধ করে আড়াই ঘণ্টায়ও কেউ সেখানে ভোট দিতে পারেনি, ছাত্রলীগ ফাঁকা ফাঁকা করে দীর্ঘ লাইন সৃষ্টি করেছে। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, বঙ্গবন্ধু হল ও জিয়া হলে অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের হলে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়েছে। এসব পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এই প্রহসন এবং জালিয়াতির নির্বাচনকে আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের জিএস প্রার্থী রাশেদ খান, এজিএস প্রার্থী ফারুক হাসান, প্রগতিশীল ছাত্র ঐক্যের জিএস ফয়সাল আহমেদ, ভিপি প্রার্থী উম্মে হাবিবা বেনজীর, স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী অরণী সেমন্তি খান, জিএস প্রার্থী এস এম আসিফুর রাহমান, স্বাধিকার পরিষদসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। লিটন নন্দী আরো বলেন, আমরা সকাল থেকে নির্বাচন দেখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমরা কী দেখলাম। আমরা যা বলেছিলাম তা-ই হচ্ছে। আমরা বলেছিলাম হলগুলোতে সুষ্ঠু পরিবেশ নেই, সে জন্য ভোটকেন্দ্র অ্যাকাডেমিক ভবনে করতে হবে। তাঁরা বলেছিলেন, সুষ্ঠু পরিবেশ রয়েছে। আমরা বলেছিলাম, ভোট দেওয়ার পর ভোটারদের হাতে কালি লাগাতে হবে, নাহলে তো বোঝা যাবে না কে ভোট দিচ্ছে কে দিচ্ছে না। তাঁরা বলেছিলেন সেটাও লাগবে না। আমরা দাবি করেছিলাম, ভোট গ্রহণের সময় বাড়াতে হবে। তাঁরা বলেছিলেন, এই সময়ের মধ্যেই হবে। আমরা বলেছিলাম স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স রাখতে, তাঁরা বললেন লাগবে না। পোলিং এজেন্ট রাখতেও দিলেন না; তাঁরা বললেন, তাদের ওপর বিশ্বাস রাখতে, সেই বিশ্বাসের নমুনা আমরা দেখতে পেলাম আজ। পুনঃতফসিল ঘোষণা করে অ্যাকাডেমিক ভবনে ভোট গ্রহণ করতে হবে। ব্যর্থ নির্বাচন কমিটি বাতিল করে সবার মতামতের ওপর ভিত্তি করে নতুন কমিটি তৈরি করতে হবে। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ব্যবহার করতে হবে। আগের দাবিগুলোর যথার্থতা প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া ভোট গ্রহণের সময় সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা করার দাবি জানিয়ে লিটন নন্দী বলেন, আজকের ভোট জালিয়াতি ও অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের জিএস প্রার্থী মুহাম্মদ রাশেদ খান বলেন, ভোট ডাকাতি, জালিয়াতি ও প্রশাসনের এই নীলনকশার নির্বাচন আমরা মানি না। তিনি বলেন, সকালে স্যার এ এফ রহমান হলসহ অন্যান্য হলে অনিয়মের দৃশ্য দেখে আমরা রোকেয়া হলে যাই। সেখানে নয়টি ব্যালট বাক্সের মধ্যে ছয়টি আনা হয়েছে। আর তিনটি বাক্স তালা মারা একটি কক্ষে রেখে দেওয়া হয়েছে। রাশেদ খান বলেন, সব ছাত্রসংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে আমরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলব। আমরা বিক্ষোভ করব এবং আমাদের কর্মসূচি লাগাতারভাবে চলতে থাকবে। স্বাধিকার পরিষদের জিএস প্রার্থী এ আর এম আসিফুর রহমান বলেন, আমরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করে উপাচার্যের কাছে যাব। সব ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ থাকবে। এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘অনিয়মের নির্বাচন মানি না মানব না’, ‘লাগাতার ধর্মঘট দিয়ে দাও’ স্লোগান দিতে থাকেন। সবার শেষে প্রগতিশীল ছাত্র ঐক্যের ভিপি প্রার্থী লিটন নন্দী বলেন, আমরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেব। পরে নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির ঘটনায় ইসলামি শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন নির্বাচন বর্জন করে। সোমবার দুপুর ২টায় ইসলামি শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন সমর্থিত আতায়ে রাব্বী-মাহমুদ-শরিয়ত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী এস.এম.আতায়ে রাব্বী ও জিএস প্রার্থী মাহমুদুল হাসান এক যৌথ বিবৃতিতে ডাকসু নির্বাচনের ভোট বর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। এই নির্বাচনে মোট ভোটার ৪৩ হাজার ২৫৫ জন। আর ডাকসুর ২৫টি পদের বিপরীতে মোট ২২৯ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। প্রতিটি হলে নির্বাচিত হবেন ১৩ জন করে। সেই হিসাবে ১৮ হল সংসদে প্রার্থী রয়েছেন মোট ৫০৯ জন।