কলাপাড়ায় পুকুর জলাশয় ভরাটে পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কা!

প্রথম পাতা » পটুয়াখালী » কলাপাড়ায় পুকুর জলাশয় ভরাটে পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কা!
শুক্রবার ● ১৩ অক্টোবর ২০২৩


কলাপাড়ায় পুকুর জলাশয় ভরাটে পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কা!

মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) সাগরকন্যা অফিস॥

সাগরপারের জনপদ উপকূলীয় কলাপাড়ায় পুকুর ও জলাশয় ভরাটের হিড়িক চলছে। গত দুই যুগে এখানে অন্তত আট হাজার পুকুর ভরাট করা হয়েছে। অর্থনৈতিভাবে লাভবান হওয়ার স্বার্থে ব্যক্তিমালিকানা পুকুর ভরাট চলছে। আর এর ভয়াবহ বিরুপ প্রতিক্রিয়া এখন দেখা দিয়েছে গোটা উপকূলজুড়ে। ফলে গোসল, রান্নাসহ নিত্য কাজে ব্যবহারের জন্য পানির সঙ্কট তীব্র আকার ধারন করেছে। পানির সঙ্কটে মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়ছে ডায়রিয়াসহ নানান রোগ বালাইয়ে।
সরেজমিনে না দেখলে বোঝার উপায় নেই যে, কীভাবে পুকুর ভরাট করা হয়েছে। যে যেভাবে পারছে পুকুর ভরাট করছে। পুকুরগুলো ভরাট করে বাড়িঘরসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা তোলা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি পুকুর ভরাট হয়েছে কলাপাড়া পৌর শহরে। এখানে অন্তত চার শ’ পুকুর ভরাট করা হয়েছে। ড্রেজার লাগিয়ে বালু দিয়ে ভরাট করে সেখানে তোলা হয়েছে স্থাপনা। এই ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। এসব পুকুরের পানি মালিকসহ আশপাশের পড়শি মানুষ গোসল, রান্নাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করত। বর্তমানে অবস্থা এমন হয়েছে যে পৌরশহরে পৌরসভার পানির সরবরাহ একটি দিন বন্ধ থাকলে জনজীবনে দুর্বিষহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। মানুষ চরম বিপাকে পড়ছেন। ব্যক্তি মালিকরা পুকুর ভরাট করা ছাড়াও সরকারি বেসরকারি সংস্থাও পুকুর ভরাট কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যেমন পৌর শহরের এতিমখানা পুকুরটি ভরাট করে সেখানে পৌর ভবন তোলা হয়েছে। ওই পুকুরটির পানি প্রতিদিন অন্তত হাজারো মানুষ গোসল রান্নাসহ নিত্যকাজে ব্যবহার করত। পুকুর ভরাট করে এই অঞ্চলে মানুষ বসবাসের চিরচেনা বাড়িঘরের আদল বদলে ফেলছে। পুকুর ভরাটের কারনে  ভূ-উপরিভাগের পানির ব্যবহার আশঙ্কাজনকহারে কমে যাচ্ছে। বাড়ছে ভূপৃষ্ঠের পানির ব্যবহার। চাপ পড়ছে গভীর নলকূপের উপরে। গোসলের সময় ভিড় লেগে যায়। ইতোমধ্যে শতাধিক গভীর নলকূপ নষ্ট হয়ে গেছে। পানির স্তর অঞ্চলভেদে তিন থেকে পাঁচ ফুট নিচে নেমে গেছে। পুকুর ভরাটের কারনে ব্যবহারের পানির সঙ্কটে গ্রামাঞ্চলে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়েছে।
পটুয়াখালী বরগুনা মৎস চাষ সম্প্রসারণ প্রকল্প পরিচালিত ১৯৯৮ সালের এক জরিপের তথ্যমতে কলাপাড়ায় মোট পুকুর সংখ্যা ১৭ হাজার এক শ’ ৩৪ টি। এর মধ্যে বড় পুকুর (এক হাজার বর্গ মিটারের বেশি) ছিল ১৫৬৪টি। মাঝারি পুকুর ১০ হাজার ৫৪ টি। ছোট পুকুর ছিল পাঁচ হাজার দুই শ’ ৭৮টি এবং ডোবা ছিল ২৩৮টি। এছাড়া খাস পুকুর ছিল ১০৮টি। কিন্তু বর্তমানে অর্ধেক পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। ওই তথ্যমতে কলাপাড়া পৌর শহরের পুকুর সংখ্যা ছিল ৬৪০টি। যার দুই তৃতীয়াংশ ভরাট হয়েছে বলে দাবি পৌরবাসীর। লতাচাপলী ইউনিয়নের দৃশ্য একই। সেখানে ওই সময় পুকুর ছিল ১৮৮০টি। যার দুই তৃতীয়াংশ ভরাট করা হয়েছে। কুয়াকাটার অবস্থান লতাচাপলীতে হওয়ায় সেখানকার ব্যক্তি মালিকানা এবং সরকারি খাস পুকুর পর্যন্ত ভরাট করে বিক্রি করা হয়েছে। কুয়াকাটার মাঝিবাড়ি এবং খাজুরা এলাকায় শরীফপুর এলাকাজুড়ে পুকুরের পাশাপাশি সরকারি অন্তত ৫টি দীর্ঘ খাল ভরাট করে বিভিন্ন আবাসন কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দখল পর্যন্ত বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে এখন ব্যবহারের পানি তো দুরের কথা। মানুষ বসবাস করাও দুরুহ হয়ে গেছে। সেখানকার হাজারো লোকজন এসবের প্রতিবাদে মানবন্ধন পর্যন্ত করেছে। কলাপাড়া পৌরসভায় সরকারি হিসাবে ২৪টি খাস পুকুর রয়েছে। তার অর্ধেক এখন ভরাট হয়ে গেছে। নাচনাপাড়া চৌরাস্তা এলাকায় একটি খাস পুকুর ভরাট করে সেখানে এখন ফ্রি-স্টাইলে তোলা হয়েছে স্থাপনা। লতাচাপলীর রাখাইন পল্লী কালাচানপাড়ায় সরকারি খাস পুকুর দখল করে সেখানে বহুতল মার্কেটসহ অসংখ্য স্থাপনা তোলা হয়েছে। পুকুর দু’টির পানি এখন দুষিত। মানুষ বর্জ্য ফেলে ভাগাড়ে পরিণত করেছে। বর্তমানে ফ্রি-স্টাইলে তাৎক্ষণিক লাভের আশায় পুকুর ভরাট করে নিরাপদ পানির ব্যবহারে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। প্রাকৃতিক জলাধার আইনানুসারে কোন ধরনের পুকুর ভরাট করার সুযোগ নেই। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আইনের প্রয়োগ নেই। পৌরপরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদসহ পরিবেশ অধিদফতর রয়েছে। কিন্তু মানুষের সবচেয়ে অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন নিরাপদ পানির উৎসগুলো পুকুর দেদার নষ্ট হয়ে গেলেও তারা রয়েছেন নির্বিকার। কোথাও কোন আইনের প্রয়োগ নেই। সামাজিক কোন দায়বদ্ধতা পর্যন্ত নেই ।
কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসক ডাঃ চিন্ময় হাওলাদার জানান, পুকুর ভরাটে নিরাপদ পানির সঙ্কট রয়েছে। এর ফলে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগব্যধি বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। এমনকি জীবন যাপনে ভয়াবহ বিপর্যস্ত পরিবেশের শঙ্কা রয়েছে। পরিবেশ বিশেষঞ্জের মতে পৌর এলাকায় ব্যক্তিগতভাবে পুকুর খনন কিংবা ভরাটের জন্য পৌর কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়া কত সংখ্যক মানুষের ব্যবহারের জন্য কতটি পুকুর দরকার তা সংরক্ষণের দায়িত্ব পৌর কর্তৃপক্ষের। এব্যাপারে কলাপাড়া পৌর মেয়র বিপুল চন্দ্র হাওলাদার জানান, পরিকল্পিতভাবে যেসব পুকুর জনস্বার্থে সংরক্ষণ করা দরকার তা রক্ষার্থে পুনর্খনন করার উদ্যোগ পর্যন্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া মশা সৃষ্টিকারী যেসব ব্যক্তিগত পর্যায়ের ডোবা রয়েছে, দুষিত পানি থাকছে তা ভরাট করতেও পরামর্শ দেয়া হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, খাস পুকুর দখল রোধে উদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

 

 

এমইউএম/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ০:১৪:০৩ ● ১০৯ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ