মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) সাগরকন্যা অফিস॥
পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় সরকারের খাস জমি দখলের তান্ডব কোন কিছুতেই থামছেনা। বিভিন্ন কায়দায় চলছে এ দখল দৌরাত্ম। এর অন্যতম একটি বন্দোবস্ত প্রক্রিয়া, তাও আবার ভূমিহীন সেজে। প্রথমে ভূমিহীনদের নামে নিয়ে তারপরে অবৈধভাবে হস্তান্তর। এভাবেই কৌশলে বেহাত হচ্ছে সরকারের খাস জমি। দীর্ঘ অনুসন্ধানে এসব জানা গেছে।
ভূমিহীন আলী আকবর গাজীর বাড়ি চাকামইয়া ইউনিয়নে। ১৯৭-কে/১৯৭৪-১৯৭৫ নং বন্দোবস্ত কেসের মাধ্যমে দেড় একর খাস জমি বন্দোবস্ত দেয়া হয়। ১৯৮৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি এ পরিমান জমি দলিল করে দেয়া হয়। দলিল নং-১১৬৯। ১৯৮৬ সালের ১৭ এপ্রিল খতিয়ান খুলে দেয়া হয়, এসএ-৬৪৬। কিন্তু ১৯৮৬ সালের ১৪ জুন এ জমি বিক্রি করে দেন আলী আকবর গাজী। যার দলিল নং ৪৩০৩। বন্দোবস্তের কবুলিয়াতের শর্ত ভঙ্গ করে বিক্রির কারণে কেসটি বাতিল যোগ্য। ভূমি অফিসের তদন্ত প্রতিবেদনে এসব উল্লেখ রয়েছে। কেসটি বাতিলের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে। ২০১৬ সালের ২৪ জুন নেয়া এই সিদ্ধান্ত এখনও আলোর মুখ দেখেনি। একই ভাবে ৩৫০ কে/১৯৮৯-১৯৯০, ২১১ কে/২০০৮-২০০৯ বন্দোবস্ত কেস এর। কবুলিয়াতের ২০ নম্বর শর্ত ভঙ্গ করা হয়েছে। এ বন্দোবস্ত নথি দু’টিও বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। ধূলাসার ইউনিয়নের ১৩৮ কে/১৯৮৯-১৯৯০ নং বন্দোবস্ত কেসটিতে দুই একর জমি বন্দোবস্ত দেখানো হয়েছে। যেখানে নথিতে বন্দোবস্ত গ্রহীতার পিতার নাম কবুলিয়াত ফরমে কাটাকাটি করে রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। ২১৩-কে/২০০৮-২০০৯ নং বন্দোবস্ত কেসটিতে দেখা গেছে দুই একর ১১ শতক জমির মধ্যে একটি বিশাল পুকুর রয়েছে। ৫৪-কে/২০১০-২০১১ ও ৫৭-কে/২০১০-২০১১ বন্দোবস্ত কেসের ৯৩০ নম্বর দাগের ২৫ শতক জমিতে বর্তমানে ৩-৬ ফুট পানি রয়েছে। এমনসব অসংখ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে বন্দোবস্ত গ্রহীতাদের বিরুদ্ধে। একই দশা ৩০০ ও ৩০২-কে/২০০৬-২০০৭ বন্দোবস্ত কেস দু’টির।
মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য মোঃ মাসুদ জানান, তার এলাকায় পানিতে ভরা এমন একটি খালকে চাষযোগ্য কৃষিজমি দেখিয়ে বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে। প্রায় পাঁচ বছর আগে এলাকার কৃষকের পক্ষ থেকে একটি লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু আজ অবধি এটির কোন সুরাহা হয়নি। এখন মানুষ জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছে। এমনসব অভিযোগ নিত্যদিনের। লতাচাপলী মৌজায় অন্তত কয়েকশ’ ত্রুটিপুর্ণ বন্দোবস্ত কেস রয়েছে। যা বাতিল করা প্রয়োজন। এখানে আবার এসব ভুয়া কৃষি খাসজমি বন্দোবস্ত দেখিয়ে লুচ খতিয়ানের মধ্য দিয়ে দখলে রাখা হয়েছে। পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটার উন্নয়নে এসব খাস জমি উদ্ধার করা প্রয়োজন। নইলে এ জমি আবার সরকারের উন্নয়নকাজে কোটি কোটি টাকার বিনিময় অধিগ্রহণ করতে হবে। কুয়াকাটা পৌর এলাকার লতাচাপলী মৌজার এসএ ৫১৭৪-৫১৭৮, ৫৪৩৭-৫৪৩৯ ও ৫৬৫৪ নং দাগসমুহে চার একর ৭৭ শতক খাস জমি নিয়ে ১৩৪৬ নম্বর একটি লুচ খতিয়ান খোলা হয়। এ খতিয়ানটি ভুয়া, অবৈধভাবে সৃজিত উল্লেখ করে ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ভূঃ রাঃ ৯৬৬/কলা নং স্মারকে এ কলাপাড়ার ভূমি প্রশাসন খতিয়ানটি বাতিল করে। কুয়াকাটা পৌরসভার মধ্যে এ পরিমাণ জমির বর্তমান মূল্য রয়েছে অন্তত ২৫ কোটি টাকা। এ জমি দখল করে এখন একটি আবাসন কোম্পানি স্থাপনা তুলেছে। কিছু অংশ দখল করে এক কাউন্সিলর বহুতল বাড়ি ও হোটেল করেছে।
পশ্চিম কুয়াকাটার মাঝিবাড়ি এলাকায় এস এ ৪৭৫৬ ও ৪৭৫৭ নম্বর দাগের দেড় একর খাস জমি সাগর নীড় নামের একটি হাউজিং কোম্পানি দখল করে নেয়। এটি খাল ছিল। ২০১০ সালে ভরাট করে নেয়। এখনও এ জমিতে কোন স্থাপনা করা হয়নি। এভাবে সরকারের শত শত কোটি টাকার খাস জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। এসব খতিয়ান এবং ত্রুটিপুর্ণ বন্দোবস্ত কেস শণাক্ত করে ভূমি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে চিহ্নিত করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ২০১১ সালে। তৎকালীন ভূমি সচিব এ আদেশ দেন। ২০১১ সালের প্রথমদিকে সরকারিভাবে লতাচাপলী, চরচাপলী, কাউয়ারচর ও গঙ্গামতি মৌজার খাস জমি বন্দোবস্ত প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। এই নির্দেশনায় বেনামে ভূমিহীন সাজিয়ে বন্দোবস্ত কেস খাস জমি উদ্ধারে পর্যটন এলাকা কুয়াকাটায় ভূমিহীনদের নামে দেয়া ত্রুটিপূর্ণ বন্দোবস্ত কেস শণাক্ত করতে গঠিত বিশেষ কমিটি তখন কাজ শুরু করে। ২০১১ সালে ভুমি মন্ত্রনালয়ের ৭ এপ্রিলের ২৬৯ নম্বর স্বারকে পটুয়াখালীর জেলাপ্রশাসক ৯ মে এক চিঠিতে এ লক্ষ্যে পাঁচ সদস্যের গঠিত এই কমিটির প্রধান হলেন, অতিরিক্তি জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)। এছাড়া এই কমিটির অন্যান্য সদস্য হলেন, রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর পটুয়াখালী, কলাপাড়া ভূমি অফিসের কানুনগো এবং এসএ শাখার সার্ভেয়ার। এছাড়া কলাপাড়ার সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) সদস্য সচিব করা হয়েছে। ওই কমিটির নির্দেশনায় তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) আট শতাধিক বন্দোবস্ত কেস যাচাই-বাছাইয়ের জন্য শণাক্ত করেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে এ কাজের অগ্রগতি থমকে আছে। উল্টো বর্তমানে নামে-বেনামে কিংবা ত্রুটিপুর্ণভাবে বন্দোবস্ত নেয়া খাস জমি অনিয়মতান্ত্রিকভাবে হস্তান্তর চলছে। খাসজমি বন্দোবস্ত ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এমইউএম/এমআর