নির্বাচন এলেই শঙ্কা বাড়ে সংখ্যলঘুদের

প্রথম পাতা » পটুয়াখালী » নির্বাচন এলেই শঙ্কা বাড়ে সংখ্যলঘুদের
সোমবার ● ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩


নির্বাচন এলেই শঙ্কা বাড়ে সংখ্যলঘুদের

সোহরাব হোসেন, সাগরকন্যা (পটুয়াখালী) অফিস॥

নির্বাচন এলেই প্রভাবশালীদের হুমকি-ধামকি এমনকি নির্যাতনও নেমে আসে তাদের ওপর। শুধু তাই নয় দেশ ছাড়তেও হয় কারো কারো। তাই নির্বাচন এলেই পটুয়াখালীতে বিগত নির্বাচনের ভীতিকর পরিস্থিতির কথা মনে করিয়ে দেয় এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনদের। পরিবার-পরিজন নিয়ে অজানা আতঙ্কে দিন কাটাতে হয়।

নির্বাচন এলেই রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী প্রার্থীরা নির্বাচনে জয়ী হতে নানা ধরনের কৌশল গ্রহন করেন। এসব কৌশলের একটি হচ্ছে হুমকি-ধামকি। অপেক্ষাকৃত দুর্বল লোকদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে ভোট আদায় কিংবা ভোট দানে বিরত রাখার জন্য এসব প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চান। অনেক ক্ষেত্রে তারা সফলও হন। এসব প্রভাবশালীরা পরাজিত হলে দুর্বল বা সংখ্যালঘু ভোটারদের ওপর স্বাভাবিক কারণে ক্ষোভ বহুগুনে বেড়ে যায়। পরাজয়ের দায় চাপানো হয় সংখ্যালঘু ভোটারদের ওপর। আবার বিজয়ী হবার পরেও এসব দুর্বল ভোটারদের ওপর নির্যাতন থেমে থাকে না। পটুয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে এমন অনেক উদাহরণ পাওয়া গেছে।

জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলার মাধবখালী ইউনিয়নের সন্তোষপুর গ্রামের গোবিন্দ চন্দ্র তালুকদার। পেশায় ছিলেন একজন গ্রাম্য চিকিৎসক। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোট কেন্দ্র না যাবার জন্য তাকে হুমকি দেয়া হয়েছিল। ওই হুমকি উপেক্ষা করে তিনি ভোট দেন। আর এ কারণে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ভাংচুর, লুটপাট চালানো হয়। তাকেও শারীরিক ভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। দুঃখে-ক্ষোভে তিনি দেশ ছেড়ে সপরিবারে পাড়ি জমান ভারতে।
তার ভাই গোপাল চন্দ্র তালুকদার জানান, ভাই সপিরবারে ভারতে চলে গেছেন। কিন্তু নির্বাচন এলে আমরাও তটস্থ থাকি আমাদের ভাগ্যেও এমন দুর্ঘটনা নেমে আসে কিনা।

ওই উপজেলার তারাবুনিয়া গ্রামের যতীন চন্দ্র মিস্ত্রি। তিনিও গ্রাম্য চিকিৎসক ছিলেন। তাকেও অনুরুপ হুমকি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি হুমকি উপেক্ষা করে ভোট দিয়েছিলেন আর তাই নির্বাচনের পরে এক রাতে তার বসতঘরে ঢুকে হামলা-ভাংচুর চালানো হয়। ওই ঘটনার রাতে তার কলেজ পড়–য়া মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। লজ্জায়, ক্ষোভে তিনি রাতের আধারে পরিবারসহ দেশান্তর হন।

ওই উপজেলার আরেক সংখ্যলঘু পরিবারের সদস্য কিরণ চন্দ্র সরকার। তাকে নির্বাচনের দিন এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। পায়রা নদী সাঁতরে কোন রকমে তোপের মুখ থেকে বাঁচলেও পরে প্রকাশ্যে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয় তাকে। ওই ঘটনায় পরবর্তীতে সে একটি মামলাও করে যা আদালতে স্থগিত রয়েছে।

কিরণ সরকার জানান, বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন এলেই আমরা সংখ্যলঘু সম্প্রদায়ের লোকজন শঙ্কার মধ্যেই থাকি। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসে ততই এ শঙ্কা বাড়ে। আমরাও তো এদেশের নাগরিক। তাহলে আমাদেরকে কেন নিরাপত্তাহীনতায়  থাকতে হবে?

ওই উপজেলার ঘটকের আন্দুয়া গ্রামের জগদিশ চন্দ্র শীল ও তার সহোদর হিরণ চন্দ্র শীলের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানোর অভিযোগ রয়েছে। হিরণ শীল জানান, নির্বাচন এলে আমরা পরিবার-পরিজন নিয়ে ভয়ে থাকি। কখন কি হয় সে আতঙ্কে কাটে আমাদের দিন-রাত। আমাদের নিরাপত্তার বিষয়টি রাষ্ট্রের ভাবা উচিত।

হিরণ শীলের স্ত্রী অনামিকা রানী বলেন বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে এসে নির্বাচন পরবর্তী এ দুর্ঘটনার কথা শুনেছি। তাই এখন সামনে নির্বাচনের কথা আসতেই পুরনো দিনের হামলা-নির্যাতনের কথা মনে পড়ছে।

এরকম  নির্বাচন কেন্দ্রিক সংখ্যালঘুদের ওপর হুমকি, নির্যাতনের অনেক ঘটনা থাকলেও সব ঘটনা প্রকাশ্যে আসেও না। অনেকে মুখ বুজে সহ্য করেন আবার অনেকে ভয়ে প্রকাশ করতে চান না।
মাধবখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মিজানুর রহমান লাভলু জানান, নির্চাবন এলে সংখ্যালঘু সম্প্রাদয়ের লোকজন তো একটা অজানা আতঙ্কের মধ্যে থাকেনই। এছাড়াও সংখ্যগুরু সম্প্রদায়ের কিছু দুর্বল লোকেরাও এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হন যা কোন ভাবেই কাম্য নয়।
স্থানীয় বিএনপি নেতা বাবুল চৌধুরীর নেতৃত্বে এসব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে বলে ভুক্তভোগীরা নিশ্চিত করেন। বাবুল চৌধুরী করোনাকালে মৃত্যুবরণ করেন। তবে বাবুল চৌধুরীর সহযোগীদের কেউ এ ব্যাপারে কোন বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
এ ব্যাপারে পটুয়াখালীর হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি অতুল চন্দ্র দাস বলেন, নানা কারনে সংখ্যালঘুদের ওপর প্রভাবশালীরা কর্তৃত্ব করেন। তারমধ্যে নির্বাচনকালীন হুমকি ছাড়াও জমি-জমা, ঘর-বাড়ির দখলের বিষয়ও আছে। তবে নির্বাচন এলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন বেশি ভয়ের মধ্যে থাকেন। এক্ষেত্রে তাদের সার্বিক নিরাপত্তায় রাজনৈতিক দলগুলো ও রাষ্ট্রের জোরালো ভূমিকা থাকা দরকার।

পটুয়াখালী পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি স্বপন ব্যানার্জী বলেন, নির্বাচনকালীন সংখ্যালঘুদের হুমকির বিষয়টি খুবই উদ্বেগ জনক। এক্ষেত্রে সরকারসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সহনশীল মনোভাব আমরা আশা করি। কারন বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। এখানে ধর্ম-বর্ণ সকলে সমান ভাবে জীবন যাপন করনে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

এ ব্যাপারে পটুয়াখালীর পুলিশ সুপার মো. সাইদুল ইসলাম জানান, শুধু সংখ্যালঘু নয় সকল ভোটার যাতে নির্বিঘেœ ভোট দিতে পারেন সেজন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। নির্বাচনকালীনসহ পুলিশ প্রশাসন সব সময় জনগণের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে নিরলস কাজ করছে।

 

 

 

এসএইচ/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ২০:৩১:৫০ ● ৬৭৭ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ