জাহিদ রিপন, সাগরকন্যা (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি॥
অধিগ্রহনে হারিয়েছেন বসতভিটাসহ আবাদি জমি। হয়েছেন অন্যের বাড়িতে আশ্রিতা। পড়েছেন জীবিকার অনিশ্চয়তায়। অধিগ্রহনের ৪বছর পেরিয়ে গেলেও এমন মানবেতর জীবন মেনে নিতে হয়েছে উপজাতি রাখাইন সম্প্রদায়ের ৬টি পরিবারকে। জীবিকার নিশ্চয়তা নয়, শুধুমাত্র মাথা গোজার ঠাইটুকু খুজে পেতে ঘুরছেন প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে। এমন দাবী ৬টি ক্ষতিগ্রস্থ রাখাইন পরিবারের। অপরদিকে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, ৬টি রাখাইন পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য পায়রা বন্দর র্নিমিত আবাসনে পূর্নবাসনের ব্যবস্থা করা হলেও তারা সেখানে যেতে আগ্রহী নয়।
ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার সূত্র জানায়, ১৭৮৪ সালে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার টিয়াখালী ইউনিয়নের ৫.৫৪ একর ঘন বন জঙ্গলে পরিপূর্ন অনুর্বর জমিতে ছয়ানীপাড়া পাড়া প্রতিষ্ঠা করে জনবসতি গড়ে তোলে উপজাতি রাখাইন সম্প্রদায়। এক সময় এখানে অর্ধশতাধিক পরিবারে বসবাস ছিল। ফসলহানি, কর্মহীনতা, দারিদ্রতা, অভাবসহ বাঙ্গালী কৃস্টি-কালচারের সাথে খাপ থাওয়াতে না পেরে অধিকাংশ পরিবার পার্বত্য এলাকাসহ মায়ানমারে গিয়ে বসতি শুরু করে। কিন্তু বাস্তবতার সাথে সংগ্রাম করে টিকে থাকা ৬টি পরিবার।
২০১৯ সালে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ পাড়ার সব জমি অধিগ্রহন করলে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ২৩৯ বছরের পুরনো ছয়ানীপাড়া। পাড়ায় টিকে থাকা চিং দামো রাখাইন, মোমবাচিং, মংচো, লাচিতাং, লাচি মং ও ইয়াংশি মাতুব্বরসহ ৬টি পরিবার হারায় বসতভিটা, অবশিষ্ঠাংশ চাষের জমি, ধর্মীয় উপসনালয় বৌদ্ধবিহার, পূর্ব পুরুষদের সমাধিস্থল। এসময় অস্বচ্ছল পরিবারেগুলো ঠিকানা খুজে নেয় অন্যের জমিতে আশ্রিতা হয়ে। আর মোটামুটি স্বচ্ছলরা পরিজন নিয়ে ভাড়া বাসায়।
ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর দাবী, অধিগ্রহনের ৪ বছর পেরিয়ে গেলেও ৬টি পরিবার বসতঘরসহ গাছপালার ক্ষতিপুরন পেলেও বারবারর প্রশাসনের দুয়ারে ধর্না ধরে এখনো পায়নি জমির মূল্য। পূর্নবাসনের আশ^স দিয়ে ৬টি পরিবারকে পাড়া থেকে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ উচ্ছেদ করলেও আবাসন সংকট নিরসনে এখনো নেয়া হয়নি কোন দৃশ্যমান উদ্যোগ। এনিয়ে দীর্ঘ দেনদরবারের পর জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জি এম সরফরাজসহ ভূমি অধিগ্রহন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উপস্থিতে ক্ষতিগ্রস্থ ৬টি রাখাইন পরিবারের প্রতিনিধি চিং দামো ওরফে দামো রাখাইনের সাথে জেলা প্রশাসকের দরবার হলে আলোচনায় বসে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের সহকারী পরিচালক (ভূমি) মাহামুদ হাসান। এসময় নিয়মিত আবাসন সংকটের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ৬টি পরিবারের দ্বায়িত্ব নেয় পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরই ধারাবাহিকতায় ৬টি পরিবারকে ৫ হাজার টাকা করে মাসিক বাড়ীভাড়া দেয় পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু নভেম্বর-২০২১ থেকে এপ্রিল-২০২২ পর্যন্ত তা বন্ধ করে দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ।
ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের মোমবাচিং বলেন, অধিগ্রহন প্রক্রিয়া শুরুর সংবাদ পেয়ে প্রায় আড়াই’শ বছরের পুরনো পাড়াটি রক্ষায় প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও প্রতিকার পাইনি। পাড়া থেকে উচ্ছেদ করা হলেও এখনো পূর্নবাস করা হয়নি। ৬ মাস বাড়ীভাড়া দেয়ার পরে তা বন্ধ করে দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। এনিয়েও ঘুরছি প্রশাসনের দুয়ারে দুয়ারে। বসতভিটা হারয়েছি, জমির মূল্য পাইনি। মানবেতর জীবন যাপন করছি।
ক্ষতিগ্রস্থ রাখাইন পরিবারের প্রতিনিধি চিং দামো ওরফে দামো রাখাইন বলেন, আদিবাসী সুরক্ষা আর্ন্তজাতিক আইনের ১০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, আদিবাসীদের জোর করে তাদের এলাকা বা ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা যাবেনা। ঘোষাপত্রের ২৬ ধারায় বলা হয়েছে আদিবাসীরা বংশপরমপরায় এসব সম্পদ ভোগ দখল করবে। ১৯৭২ সালের আইএলও কনভেশনের ১২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে তাদের আবাসভূমি থেকে স্বাধীন সম্পত্তি ছাড়া উচ্ছেদ করা যাবেনা। দেশের উন্নয়নের স্বার্থে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষক আমরাও জমি ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু এখনো পূর্নবাসন পেলামনা। জমির মূল্য পেলাম না। পরিজন নিয়ে বড় কস্টে আছি সবাই।
এবিষয়ে জানতে চাইলে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রকল্প পরিচালক ক্যাপ্টেন মনিরুজ্জামান বলেন, জমি অধিগ্রহনের পর কম-বেশি সবাই নানা সমস্যায় রয়েছে। সব সমস্যা সরকারের পক্ষে দ্রুত সমাধান সম্ভব নয়। ঘরভাড়া প্রদান করা ভূমি অধিগ্রহন আইনে নেই। তারপরেও জেলা প্রশাসকের নির্দেশক্রমে নিয়মবর্হিভূতভাবে ক্ষতিগ্রস্থ ওই ৬টি পরিবারকে ছয় মাস ঘরভাড়া দেয়া হয়। পায়রা বন্দর থেকে র্নিমিত লোন্দা, ধুলাস্বর আবাসন প্রকল্পে তাদের চাহিদানুযায়ী পূর্নাবাসনের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু তারা এসব আবাসনে যেতে ইচ্ছুক নয়। তবে তাদের সাথে এখনো আলোচনা চলছে। আশা করছি দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হবে।
জেআর/এমআর